রাজধানীর শাহবাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগোতেই ঢাবির ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনের (টিএসসি) সামনে দেখা মিলল ‘জিতবে ক্যাম্পাস এ ফাগুনে’ লেখা একটি ফেস্টুন। ফেস্টুনটি লাগিয়েছে ঢাবি ছাত্র ইউনিয়ন। শুধু ছাত্র ইউনিয়ন নয়, এখন পুরো দেশের ছাত্রসমাজ ক্যাম্পাসের বিজয় দেখার জন্য তাকিয়ে আছে ঢাবির দিকে। কারণ ক’দিন পরেই ডাকসু (ঢাবির ছাত্র সংসদ) নির্বাচন, যে নির্বাচনের জন্য দীর্ঘ প্রায় ২৮ বছর প্রতীক্ষায় থাকতে হয়েছে গোটা বাংলাদেশকে। কারণ এই ডাকসু ছিল একসময় ছাত্র নেতৃত্ব বিকাশের সফল কারখানা, সংস্কৃতিচর্চার বাতিঘর। নিভে থাকা এই বাতিঘরে অনেকদিন পর ফের আলো জ্বলবে, সে আলোয় আলোকিত হবে হাজারো স্বপ্ন।
ডাকসু নির্বাচন শুধুই নির্বাচন নয়, ডাকসু বাংলার নানান ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী, ডাকসুর বদৌলতে জন্ম হয়েছে অনেক বাঘা বাঘা জাতীয় নেতার। ডাকসুতে যারা বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা জাতীয় সঙ্কটের সময়ে অনেক অবদান রেখেছেন। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ’৯০-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ডাকসু নেতাদের অনবদ্য অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদের সবশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এরপর কয়েক দফায় নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। দীর্ঘদিন পর আগামী ১১ মার্চ বহুল প্রত্যাশিত এ নির্বাচনকে ঘিরে ক্যাম্পাসে সরগরম ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো। নির্বাচনে সব ছাত্র সংগঠন অংশ নিতে যাচ্ছে, এর বাইরে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরাও প্যানেল নিয়ে নামছে ভোটের এ লড়াইয়ে। ইতোমধ্যে সব দলই তাদের পছন্দের প্রার্থীদের নিয়ে প্যানেল দিয়েছে। মনোনয়ন জমা দিয়েছে, মনোনয়ন বাছাই কাজও শেষ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এ উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে রাজনীতি সচেতনসহ মানুষের মধ্যে। রাজনীতির অন্দর মহলের আলোচনায়ও উঠে আসছে ডাকসু নির্বাচন। প্রতিদিনই ছাত্রনেতাদের আড্ডায় জমে উঠছে ছাত্ররাজনীতির ‘রাজনীতির আঁতুড়ঘর’খ্যাত মধুর ক্যান্টিন।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে মানুষের আশার আলো বা স্বপ্ন বোনার মূল কারণই হলো এ নির্বাচনে সব ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের অংশগ্রহণ। এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে রয়েছে সব দলের সহ-অবস্থান। দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসছাড়া ছাত্রদল এখন ক্যাম্পাসে যাচ্ছে। ছাত্রদের পাশে যাচ্ছে, নিজেদের প্যানেলের পক্ষে ভোট চাচ্ছে। বাম ছাত্র সংগঠনগুলোও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ক্যাম্পাস। পিছিয়ে নেই কোটা আন্দোলনকারীসহ অন্যরাও।
অথচ ছাত্রদলের অভিভাবক সংগঠন বিএনপি, বাম গণতান্ত্রিক জোট একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছে। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সম্মিলিতভাবে পেয়েছে মাত্র আটটি আসন। বিজয়ী এসব প্রার্থী এখনো শপথ নেননি। জোটের শরিক গণফোরাম থেকে নির্বাচিত দুজন শপথ নেওয়ার পক্ষে থাকলেও বিএনপির নির্বাচিত ৬ জন শপথ নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। বাকি ২৯২টি আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগ এবং তার সমর্থিত দল ও ব্যক্তিরা। নির্বাচনের দিনই নজিরবিহীন কারচুপি এবং অনিয়মের ব্যাপক অভিযোগ তুলেছেন সরকারবিরোধীরা। পুনর্নির্বাচনের জন্য তারা আন্দোলন করে যাচ্ছেন। এ সরকারের আমলে আর কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না দাবি করে তারা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন না। অংশগ্রহণ করেননি ডিএসসিসি’র উপনির্বাচনেও। কিন্তু ছাড় দেয়নি ডাকসু নির্বাচনে। কারণ ডাকসু হলো রাজনীতির আঁতুড়ঘর। ডাকসুতে সহসাই ছাড় দিলে চলবে না। আর তারা চায় এ লড়াইয়ে জিততে।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে রাজনীতি সচেতনসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন উৎসাহ আছে, ঠিক তেমনি রয়েছে শঙ্কাও। আর সেই শঙ্কা হলো ডাকসু নির্বাচনও ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো হবে কি-না? ডাকসু কি সুষ্ঠু নির্বাচনে আলো জ্বালাতে পারবে, নাকি পারবে না। এই শঙ্কার মধ্যেও এখনো মানুষ আশাবাদী ডাকসুর ঐতিহ্য বিলীন হবে না। রাজনীতির এ আঁতুড়ঘরের সুড়ঙ্গের পথ দিয়ে আলো আসবে। সে আলোয় উন্মোচন হবে জাতীয় রাজনীতির নতুন দ্বার, দাউদাউ করে জ্বলবে সংস্কৃতিচর্চার বাতি।
লেখক : সাংবাদিক
ংবষরসহবংি১৮—মসধরষ.পড়স