আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। তবে এরপরও ওইসময় পণ্যমূল্য কতটা স্বস্তি দেবে সেটা নিয়ে জনমনে রয়ে গেছে যথেষ্ট শঙ্কা। কারণ রমজানে যেসব পণ্যের খুব বেশি প্রয়োজন হয় সেগুলো ইতোমধ্যেই বাজারে চড়া দামে রয়েছে। আগামী দিনেও সেসব পণ্যের দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বেশ।
রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে তেল, চিনি, ছোলা, ডাল, খেজুর ও পেঁয়াজ অন্যতম। এর মধ্যে বাজারে ইতোমধ্যে দারুণ অস্বস্তি রয়েছে পেঁয়াজের দামে। একইসঙ্গে সম্প্রতি চীনে করোনা ভাইরাসের কারণে ওই দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে নতুন করে ভাটা পড়েছে। যার প্রভাবে গত এক সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়ে গেছে। সঙ্গে কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে রসুন ও আদার দাম।
কারণ তথ্য বলছে, চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ আদা ও ৮০ শতাংশ রসুন আসে চীন থেকে। এ ছাড়া ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার পরে আমদানি করা পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় অংশ আসে চীন থেকে।
অন্যদিকে গত বছরের শেষদিক থেকে বাজারে বেড়েই চলেছে তেল ও চিনির দাম। দেশি কোম্পানিগুলো এর মধ্যে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়েছে। সঙ্গে প্যাকেটজাত চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে কেজিপ্রতি ৭ টাকা। শুধু এই নয়, খোলা তেল, চিনির দামেও বড় ফারাক তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে খোলা সয়াবিন তেলের দামও লিটারপ্রতি কয়েক দফায় ১২ টাকা ও পাম সুপার তেলের দাম ১৬ টাকার মতো বেড়েছে। আর বাজেটের পর থেকে এখন পর্যন্ত খোলা চিনির দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১২ টাকার মতো।
বাজারে তেল, চিনির অন্যতম শীর্ষ সরবরাহকারী কোম্পানি মেঘনা গ্রুপ। রমজানের ওইসব পণ্যের বাজার কতটা স্থিতিশীল থাকবে এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক (বিপণন) আসিফ ইকবাল বাংলাদেশের খবরকে বলেন, গত বাজেটে কর বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তেল, চিনির দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত অবস্থার উন্নতি হয়নি। ফলে রমজানেও বাজার সেসব বিষয়গুলোর ওপর নির্ভর করবে।
এমন অনিশ্চয়তা রয়েছে ছোলা ও ডালের ক্ষেত্রেও। কয়েক মাস ধরেই দাবানলে পুড়ছে অস্ট্রেলিয়া, যার প্রভাব রয়েছে এ দুই পণ্যের দামেও। ইতোমধ্যে বাজারে মসুর ডালের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে, কিছুটা বেড়েছে ছোলারও। কারণ বাংলাদেশ হাতেগোনা কয়েকটি দেশ থেকে এসব পণ্য আমদানি করে। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজার অস্ট্রেলিয়া। এ বিষয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ডাল আমদানিকারকদের বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, বিশ্বে অন্যতম ডালের বাজার অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা। দাবানলের কারণে এ বছর অস্ট্রেলিয়াতে আবাদ বিলম্বিত হচ্ছে। ফলে সব আমদানিকারকরা কানাডার বাজারের দিকে ঝুঁকছে। এতে কানাডায় ডালের দাম ব্যাপক চড়া।
অন্যদিকে রমজানে আরেক প্রয়োজনীয় খাদ্য খেজুরের দাম কয়েক বছর ধরেই চড়া। অন্য পণ্যগুলোর তুলনায় খেজুরের বাজার ছোট হলেও আমদানির লড়াইটা এ পণ্যে বড়। মোট ১১টি দেশ থেকে গত বছর বাংলাদেশে খেজুর এসেছে। এই তালিকায় রয়েছে ইরাক। আর সেদেশে চলছে নানা জটিলতা। যদিও তার প্রভাব বাংলাদেশের খেজুরের বাজারে খুব বেশি পড়বে না বলে আশ্বস্ত করেছেন বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকজন ব্যবসায়ী।
এদিকে বাজারে পণ্যের দামের একটি হিসাব রাখে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি। সংস্থাটির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান বাজারে রমজানে প্রয়োজনীয় ছোলা ছাড়া সব নিত্যপণ্যের দাম বেশি। এর মধ্যে পেঁয়াজের দাম বছর ব্যবধানে বেড়েছে ৪৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছর এ সময় পেঁয়াজের দাম ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা। সঙ্গে তেলের দাম বছর ব্যবধানে ২৩ শতাংশ, চিনির দাম ১৯ শতাংশ, ডালের দাম ২৫ শতাংশ এবং খেজুরের দাম ১৪২ শতাংশ বেড়েছে।
কম দামে হাজার কোটি টাকার পণ্য বেচবে সরকার : রমজানের বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করবে সরকার। পবিত্র রমজান সামনে রেখে প্রতিবছরই কম দামে পণ্য বিক্রি করে সংস্থাটি। যদিও যে পরিমাণ পণ্য নিয়ে সংস্থাটি মাঠে নামে তা দিয়ে আর যা-ই হোক বাজারদর নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই সম্ভব না। তাই এ বছর পরিমাণ বেশ কিছুটা বাড়ানো হয়েছে।
ইতোমধ্যেই টিসিবির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর টিসিবি সয়াবিন তেল, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা ও খেজুর বিক্রি করে। কিন্তু পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতার কারণে এবার পণ্যটি তালিকায় যুক্ত করেছে। যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে তার বর্তমান বাজারমূল্য ১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বেড়েছে টিসিবির পণ্যের পরিমাণও : শুধু পণ্যই নয়, বাড়ানো হয়েছে বিক্রীত পণ্যের পরিমাণও। গত বছর রমজানে যেখানে আড়াই হাজার টন তেল বিক্রি করেছিল টিসিবি সেখানে এবারে বিক্রি হবে ৫০ হাজার টন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে রমজানে সাড়ে তিন লাখ টন ভোজ্যতেলের প্রয়োজন হয়, যার প্রায় ১৫ শতাংশ জোগান দেবে টিসিবি।
একইভাবে রমজানে তিন লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। আর টিসিবি বিক্রি করবে ৩৫ হাজার টন। সার্বিক পরিমাণ কম হলেও গত বছরের তুলনায় এ পরিমাণ অনেকটা বেশি। কারণ গত বছর সংস্থাটি বিক্রি করেছিল মাত্র দুই হাজার টন চিনি।
পাশাপাশি দাম নিয়ন্ত্রণে ৮ হাজার টন ছোলা বিক্রি হবে, যেখানে রমজান মাসের চাহিদা রয়েছে ৮০ হাজার টন। গত বছর বিক্রি ছিল মাত্র দেড় হাজার টন। এ ছাড়া এ বছর এক হাজার টন থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টন মসুর ডাল এবং ৮০ টন থেকে বাড়িয়ে এ বছর টিসিবির মাধ্যমে ৫০০ টন খেজুর বিক্রির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেড় লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুরোধ করা হয়েছে। বাড়তি প্রস্তুতি হিসেবে টিসিবির মাধ্যমে ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ রোজার মধ্যে খোলাবাজারে বিক্রির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
বাজার মনিটরিং হবে শক্তভাবে : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এবার বাজারে শুধু বেশি পরিমাণে পণ্য বিক্রি করা হবে তাই নয়, বাজার মনিটরিংও করা হবে বেশ শক্তভাবে। যাতে করে কেউ বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে না পারে।
মন্ত্রণালয় রমজানের বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে ইতোমধ্যে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে। যা পরিপালনে ট্যারিফ কমিশন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনসহ বিভিন্ন অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এ ছাড়া বাজারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, র্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনিটরিং টিম রাখার নির্দেশ আসছে মন্ত্রণালয় থেকে।
মজুদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক : বাণিজ্য মন্ত্রণালর থেকে পাওয়া ওই কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পাওয়া তথ্যে দেশে তেল, চিনি, ডাল, ছোলার মজুদ স্বাভাবিক রয়েছে। তবে এই মজুদ থাকার পরও যাতে কোনো প্রকার সরবরাহ সংকট তৈরি না হয় এবং কোম্পানিগুলোর উৎপাদন স্বাভাবিক থাকে সে বিষয়ে বাড়তি নজরদারির কথা বলা হয়েছে।