দেশে ফিরতে চান চীনের উহানের পাশের শহর ইচাংয়ের একদল বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে খাদ্যসহ নানা সংকটের কারণে দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন আটকে পড়া এই ১৭২ শিক্ষার্থী। ইচাং শহরের চায়না থ্রি গর্জেস ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে আলাপকালে তারা এই আকুতি জানান। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র আবু ছালেহ বলেন, আমরা এখানে খাবার আর বিশুদ্ধ পানির অভাবে আছি। খুব কষ্টের মধ্যে দিন পার করছি। দিন যত যাচ্ছে, সময় তত কঠিন হয়ে পড়ছে। ফেরার আকুতি জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতি তিনি বলেন, আমদের এখান থেকে অতি দ্রুত বের করে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমরা বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই।
নিজেদের পরিস্থিতি তুলে ধরে ছালেহ বলেন, আমরা নিজেরা চাইলেও নিজেদের ডরমিটরি থেকে বের হতে পারছি না। কারণ আমাদের শহর পুরোপুরি লক-ডাউন। এয়ারপোর্ট, এক্সপ্রেসওয়ে, ট্রেন সার্ভিস, পাবলিক-বাস, দোকানপাট, সুপারমার্কেট এবং ব্যাংকসহ সব সার্ভিস বন্ধ। ভার্সিটিও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ।
গতবছরের শেষদিন চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথমবারের মত নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়। এরপর তা দ্রুত ছড়াতে শুরু করে। এখন কেবল চীনের মূল ভূখণ্ডেই নভেল বা নতুন করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ১৪৩ জনে। চীনের বাইরে আরও অন্তত ২৫টি দেশ ও অঞ্চলে আড়াইশর বেশি মানুষ এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মারা গেছেন সব মিলিয়ে ৬৩৬ জন। বেশিরভাগ মৃত্যু ও নতুন সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে চীনের হুবেই প্রদেশে, যে প্রদেশের উহান শহরকে এ ভাইরাসের ‘উৎসস্থল’ বলা হচ্ছে। ওই শহরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা বা গবেষণায় থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে ৩১২ জনের প্রথম দলটিকে গত ১ ফেব্রুয়ারি বিশেষ বিমানে করে দেশে ফিরিয়ে আনে সরকার। সংক্রমণ রোধে তাদের ১৪ দিন আলাদা করে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
উহানের পাশের শহর ইচাংয়ে অবরুদ্ধ দশায় থাকা শিক্ষার্থীরা বলছেন, সব মিডিয়া উহান নিয়ে যতটা বলছে আশপাশের শহরে একই পরিস্থিতির মধ্যে থাকা অন্য শহরগুলোর কথা ততটা বলছে না।
চায়না থ্রি গর্জেস ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী দ্বীন মুহাম্মদ প্রিয় বলেন, আমাদের জীবনযাত্রা দিনকে দিন দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। আমরা এখানে অবরুদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যান্টিন থেকে খাবার দিলেও সেটা পর্যাপ্ত নয়।
বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সদুত্তর পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, আমাদের একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গ্রুপে দূতাবাসের একজন কর্মকর্তাও ছিলেন। কিন্তু তিনি কিছু না বলে বেরিয়ে গেছেন। দেশে যোগাযোগ করা হলে বলা হয়, আমাদের ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, দূতাবাসকেও জানানো হয়েছে। কিন্তু দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বলেন- তারা দেশ থেকে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন। এ অবস্থায় আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমরা দেশে ফিরতে চাই, আমাদের এটাই এখন একমাত্র চাওয়া।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ফায়সাল আহমেদ অনিক বলেন, আমরা ২০ দিন ধরে রুমের মধ্যে আটকে আছি। আমাদের এখানে পানি আর খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। জরুরি কিছু চাইলে তিন বা চার দিন পর পাচ্ছি। আমাদের ইউনিভার্সিটি থেকে ইউএসএ, ইংল্যান্ড, ভারত, নেপাল, মরক্কো, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গেল তাদের দেশ। অথচ আমাদের নেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই।
শিক্ষার্থীরা খাবার ও পানি সংকটের যে অভিযোগ করেছেন, তাকে ‘অযৌক্তিক’ বলছেন বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব খাইরুল বাশার। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, আমি ইউনির্ভাসিটির কোর্স কোঅর্ডিনেটর লি খর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিনি বলেছেন, শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যান্টিন চালু রেখেছেন। ওখানে ফোন করে অর্ডার করতে হয়। সকালে অর্ডার করলে দুপুরের খাবার দিয়ে যাচ্ছে। দুপুরে অর্ডার করলে রাতের খাবার দিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ফোনে অর্ডার করলে ইউনিভার্সিটির গাড়ি দিয়ে রুমে দিয়ে যাচ্ছে। তারা সেসব অভিযোগ করেছে সেগুলোর বাস্তবতা পাওয়া যায়নি। ইউনিভার্সিটি এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন।
আরেক প্রশ্নের জবাবে খাইরুল বলেন, ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে ক্যান্টিনে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশি শিক্ষর্থীরা ডরমিটরিতে রান্না করে খেতে চায়। তারা প্রতিনিয়ত চাল, ডাল, লবণ, পেঁয়াজ অর্ডার করছে। এই পরিস্থিতিতে সঙ্গে সঙ্গে সব চাহিদা মেটানো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব নয়। সেখানে বিভিন্ন দেশের ৭০০ থেকে ৮০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। চাল, ডাল, লবণ, পেঁয়াজ এনে দিতে সময়ের প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শিক্ষর্থীরা ডরমিটরিতে রান্না না করে ক্যান্টিনে খাবারের ব্যাপারে উৎসাহিত করছে।
সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ থেকে দূতাবাস কর্মকর্তার বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে খাইরুল বলেন, তথ্যের প্রয়োজনে কেউ গ্রুপে জয়েন করতে পারে, আবার ত্যাগও করতে পারে। এখানেতো প্রবলেম দেখছি না। ইচাংয়ের ব্যাপারে দূতাবাসের পক্ষ থেকে কোনো গ্রুপ খোলা হয় নাই। শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আর দূতাবাস যদি বাস্তবায়ন না করে তাহলে কী কারও চাকরি থাকবে? ঢাকা থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নাই এখন পর্যন্ত।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম গত ৩ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আরও ১৭১ জন বাংলাদেশি উহানে আছেন, যারা দেশে ফিরতে চান। সরকারও তাদের ফেরাতে চায়। সমস্যা হল, আমাদের প্লেন পাঠালে অসুবিধা হচ্ছে। আমাদের যে প্লেনটা গিয়েছিল, আসার পরে এই পাইলটদের কোনো দেশ ঢুকতে দিচ্ছে না। সেজন্য আলোচনা হয়েছে, দেখতে হবে চার্টার করা প্লেন যদি পাওয়া যায় দ্যাট উইল বি দ্য বেস্ট অপশন। চায়নিজ চার্টার করা প্লেন যদি আনা যায় সেটাকে ফার্স্ট প্রেফারেন্স দিতে হবে।