ওকে/বদরুল
ছবি আছে
মো. কামরুজ্জামান বাঁধন, মির্জাগঞ্জ (পটুয়াখালী)
পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের সুন্দ্রাকালিকাপুর গ্রামের বিধবা শেফালী বেগম ভয়াল পায়রা নদীতে মাছ ধরে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। অভাব-অনটন তার নিত্যসঙ্গী। তার ওপর ঋণের বোঝা তো রয়েছেই। ইলিশ মৌসুম শুরু হওয়ার তিন মাস আগে বেসরকারি সংস্থা আশা এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি মাছ ধরার নৌকা ও জাল কেনেন। তার আয়ের একমাত্র পথ হচ্ছে মাছ ধরা। এতেই প্রতি সপ্তাহে চলে ঋণ পরিশোধের কিস্তি। নদীতে মাছ ধরতে পারলে উনুনে হাঁড়ি বসে আর মাছ না ধরতে পারলে অনাহারে কিংবা অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয় শেফালী বেগমকে। নিজের কোনো সন্তান ও জমিজমা না থাকায় অন্যের জমিতে ঘর তুলে বসবাস করছেন। ইলিশ আহরণ বন্ধ থাকায় ঋণের কিস্তি ধারদেনা করে পরিশোধ করলেও প্রায়ই অর্ধাহারে থাকতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে বলে কেঁদে কেঁদে এ কথাগুলো বলেন বিধবা শেফালী বেগম ওরফে সেমালা। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, পায়রা নদীর ভাঙনের কারণে ৭-৮ বছর বয়সের সময় ভিকাখালী বাজারের দক্ষিণ পাশে সুন্দ্রাকালিকাপুর গ্রাম ছেড়ে কাজের সন্ধানে ঢাকার উদ্দেশে পাড়ি জমান শেফালী বেগম (৫২)। ঢাকায় বিভিন্ন বাসায় কাজের সময় পরিচয় হয় বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার তরইলিশা গ্রামের নুরুল ইসলাম গাজীর সঙ্গে। মাত্র ১২ বছর বয়সে নুরুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয়। শেফালী বেগম বলেন, স্বামীর বাড়ি মেহেন্দীগঞ্জে এসে দেখি নুরুল ইসলাম আগেও একটি বিয়ে করেছেন। সেই ঘরে স্ত্রী-সন্তানও রয়েছে। কিন্তু সে বিবাহিত তা আমার জানা ছিল না। ঢাকা থেকে মেহেন্দীগঞ্জ স্বামীর বাড়িতে গেলে সতীন (নুরুল ইসলামের বড় স্ত্রী) প্রায়ই আমাকে জ্বালাতন করত। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি, জ্বালাতন সহ্য করেও থেকেছি স্বামীর সংসারে। পাঁচ বছর আগে রোগে আক্রান্ত হয়ে নুরুল ইসলাম মারা যাওয়ায় সতীন ও তার সন্তানদের অত্যাচার আরো বেড়ে যায়। আমার কোনো সন্তান না থাকায় অভিমান ও কষ্ট নিয়ে স্বামীর ভিটে ছেড়ে বাপের বাড়ি ভিকাখালী বাজারের দক্ষিণ পাশে সুন্দ্রাকালিকাপুর গ্রামে ভাইয়ের কাছে আশ্রয় নিই। কিন্তু বিধিবাম, ভাইও বিধবা শেফালী বেগমকে ছেড়ে ঢাকায় চলে যাওয়ায় নিরুপায় হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভয়াল পায়রা নদীতে মাছ শিকার করে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন শেফালী বেগম (সেমালা)। স্বামীর বাড়ি এ উপজেলায় না হওয়ায় কোনো ভাতাও জোটেনি তার ভাগ্যে। ভাতা পাওয়ার চেষ্টা করলেও টাকার অভাবে হয়ে ওঠেনি। তাই কোনো উপায় না পেয়ে মাছ ধরার পেশাটাকে বেছে নিয়েছেন তিনি। তবে নদীতে সব সময় মাছ পাওয়া যায় না। শেফালী বেগম আফসোস করে বলেন, সরকারের মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞার সময় এখানকার জেলেরা সরকারি সাহায্যের চাল পেলেও তার ভাগ্যে জোটেনি। এ সময় তিনি আরো বলেন, ‘যে মাছ পাই হ্যা দিয়া মোর কিস্তি দেওয়ার পর কোনো রহম ডাইল-ভাত খাই, মাছ পাইলে খাই, না পাইলে না খাইয়া থাহি, পান্তে পান্তে (পানি) থাকতে আর ভালো লাগে না, ডর হরে, মইররা গ্যালে পান্তে ভাইস্যা যামু, কেউ মাডি (কবর) দেওনের লাইগ্যা মোর লাশ বিছরাইয়াও (খুঁজে পাওয়া) পাইবে না।’ তবে ভয়াল পায়রা নদীতে মাছ ধরা বাদ দিয়ে স্থানীয় ভিকাখালী বাজারে একটি চায়ের দোকান দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন এবং সরকারি বিধবা ভাতা পাওয়ার আকুতি জানিয়ে কেঁদে ফেলেন মৎস্যশিকারি বিধবা শেফালী বেগম।
এ ব্যাপারে মির্জাগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মো. মনিরুল হক লিটন বলেন, আমার ইউনিয়নে এক বিধবা নারী ভয়াল পায়রা নদীতে মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে এটা আমার জানা ছিল না। তার এই সংগ্রামী জীবনকে বিদায় দিয়ে আনন্দের নতুন জীবনের অংশীদার হতে মির্জাগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে অতিদ্রুত বিধবা শেফালী বেগমকে একটি বিধবা ভাতার কার্ড সরবরাহ করা হবে।