পরিবেশ রক্ষায় পাট ও পাটপণ্য

পাট ও পাটপণ্য পরিবেশবান্ধব এবং সহজে পচনশীলই নয়

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

পরিবেশ রক্ষায় পাট ও পাটপণ্য

  • প্রকাশিত ২৪ অক্টোবর, ২০১৮

কৃষিবিদ মো. আল-মামুন

পাট বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যময় আঁশ উৎপাদনকারী অর্থকরী ফসল। পাট ও পাটপণ্য শুধু পরিবেশবান্ধব এবং সহজে পচনশীলই নয়, এটি পরিবেশে রাখে বিরাট অবদান এবং দেশের কৃষি ও বাণিজ্যের ভারসাম্য রক্ষা করে। মাটির গুণাগুণ ও জলবায়ুগত কারণে পাট উৎপাদনকারী বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পাটের মান সবচেয়ে ভালো। বর্তমানে দেশে ৮ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে পাটের চাষাবাদ হচ্ছে

জমির উর্বরতা বৃদ্ধি : মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের গুরুত্ব অপরিসীম। পাট ফসলের মূল মাটির ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে মাটির উপরিস্তরে সৃষ্ট শক্ত ‘প্লাউপ্যান’ ভেঙে এর নিচে তলিয়ে যাওয়া অজৈব খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে মাটির উপরের স্তরে মিশিয়ে দেয়। ফলে অন্যান্য অগভীরমূলী ফসলের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ সহজ হয় এবং মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। মাটিতে পানি চলাচল সহজ ও স্বাভাবিক থাকে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, পাট ফসল উৎপাদনকালে হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৬ টন পাটপাতা মাটিতে পড়ে। পাটের পাতায় প্রচুর নাইট্রোজেন, ক্যারোটিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম থাকে। এ ছাড়া পাট ফসল কর্তনের পর জমিতে যে পাটগাছের গোড়াসহ শিকড় থেকে যায়, তা পরে পচে মাটির সঙ্গে মিশে জৈব সার যোগ করে, এতে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের সময় সারের খরচ কম লাগে।

বায়ুমণ্ডলকে শুদ্ধিকরণ : পাট একটি আঁশ উৎপাদনকারী মাঠ ফসল যা বনভূমির মতো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবেশ সুরক্ষার দিক চিন্তা করে বনের গাছ না কেটে পাট ও কেনাফ কাঠি দিয়ে স্বল্প ব্যয়ে পেপার পাল্প তৈরি করা যায়। প্রতিবছর দেশে উৎপাদিত প্রায় ৩০ লাখ টন পাটকাঠি জ্বালানির বিকল্প হিসেবে ব্যবহূত হওয়ায় বন উজাড়ের হাত থেকে কিছুটা হলেও পরিবেশ রক্ষা পায়। পাট ফসল ১০০ দিনে হেক্টরপ্রতি বাতাস থেকে প্রায় ১৪ দশমিক ৬৬ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে। ফলে পাট ফসল পৃথিবীর গ্রিনহাউজ গ্যাস ও তার পরিপ্রেক্ষিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে কিছুটা হলেও ব্যাহত করে পৃথিবীকে তার পরিবেশ রক্ষায় সহায়তা করে। আবার অন্যদিকে, প্রতি হেক্টর পাট ফসল ১০০ দিন সময়ে ১০ দশমিক ৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেনসমৃদ্ধ রাখে।

পাটপণ্যের বহুমুখী ব্যবহার : পরিবেশ রক্ষায় এবং স্বাস্থ্য উন্নত হাইড্রোকার্বনমুক্ত জুট ব্লেচিং ওয়েল উন্নয়ন, জুট ফাইবারকে বিশেষ রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে অগ্নিরোধী পাটজাত বস্ত্র উৎপাদন, পরিবেশ দূষণকারী পলিথিন ব্যাগের বিকল্প স্বল্পব্যয়ে পাটের ব্যাগ তৈরি এবং দেশের নার্সারিগুলোতে গাছের চারা সংরক্ষণে পাটের ব্যাগ (নার্সারি পট) উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানীরা। এ ছাড়া পাট কাটিংস ও নিম্নমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে প্রস্তুত করা হয় পরিবেশবান্ধব এবং ব্যয়সাশ্রয়ী জুট জিওটেক্সটাইল, যা ভূমিক্ষয় রোধ, রাস্তা ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড় ধস রোধে ব্যবহূত হচ্ছে। তাই বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বজুড়ে নানা কাজে ‘মেটাল নেটিং’ বা পলিমার থেকে তৈরি সিনথেটিক জিওটেক্সটাইলের পরিবর্তে পরিবেশ উপযোগী ও উৎকৃষ্ট জুট জিওটেক্সটাইলের কদর বাড়ছে। বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাল্প, ইনসুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিকস, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহূত হচ্ছে। এ ছাড়া ইউরোপের বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বেঞ্চ, ওডি ফোর্ড, যু্ক্তরাষ্ট্রের জিএম মোটর, জাপানের টয়োটা, হোন্ডা কোম্পানিসহ নামিদামি সব গাড়ি কোম্পানিই তাদের গাড়ির যন্ত্রাংশ ও ডেশবোর্ড তৈরিতে ব্যবহার করছে পাট ও কেনাফ। বিএমডব্লিউ পাট দিয়ে তৈরি করছে পরিবেশসম্মত ‘গ্রিন কার’ যার চাহিদা এখন প্রচুর। পাটে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ সেলুলোজ রয়েছে। পাট থেকে পাল্প তৈরি করে পুনরায় সেলুলোজ রি-জেনারেট করে ভিসকস তৈরি করা সম্ভব। আর এই ভিসকস তৈরি করতে পারলে তা সিনথেটিক তন্তুর ব্যবহার কমাবে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। ধারণা করা হচ্ছে, পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার আগামী দু্ই থেকে তিন বছরের মধ্যে সারা বিশ্বে তিনগুণ বেড়ে যাবে। ফলে পাটপণ্যের বাজারই সৃষ্টি হবে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের।

বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম তন্তু বর্জন : জলবায়ু আন্দোলনের অংশ হিসেবে পানি, মাটি ও বায়ুদূষণকারী পলিব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র জনমত তৈরি হয়েছে। বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে প্রায় ৫ লাখ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এর মাত্র ১ শতাংশ পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয় এবং সমুদ্রে ফেলা হয় ১০ শতাংশ। এসব পলিব্যাগ একশ বছরেও পচবে না ও মাটির সঙ্গে মিশবে না, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার মানুষ ছাড়াও বিপুলসংখ্যক পাখি ও জলজ প্রাণী। বাংলাদেশে ১৯৮২ সাল থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পলিথিন উৎপাদন শুরু হয়। পলিথিনের অতি ব্যবহারের কারণে ১৯৯৮ সালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ২০০২ সালে দেশে আইন করে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাত ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়। বর্জ্য পদার্থ রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদিত পলিথিন ব্যাগ শুধু খাদ্যসামগ্রীকেই বিষাক্ত করছে তা নয়, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ প্রধান শহরগুলোতে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে, তার প্রধান কারণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার। কেননা শহরের নর্দমা ও বর্জ্য নির্গমনের পথগুলো পলিথিন দ্বারা পূর্ণ। পলিথিনের কারণে পানি আটকে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের এক পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে। ব্যবহূত পলিথিন গলিয়ে আবার ব্যবহার করায় এতে রয়ে যাচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল, যা থেকে ক্যানসার, চর্মরোগ, লিভার, কিডনি ড্যামেজসহ জটিল রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা ওয়াসার সাবেক প্রধান প্রকৌশলী কাজী মুহাম্মদ শীশের তথ্যমতে, শুধু ঢাকায় ১০০ কোটি পলিথিন ব্যাগ ভূপৃষ্ঠের নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ফলে মাটির নিচেও সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন স্তর, যা ভূপৃষ্ঠে স্বাভাবিক পানি ও অক্সিজেন প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে জমির শস্য উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করছে। একই সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠকে ক্রমাগত উত্তপ্ত করে তোলার নেপথ্যে রয়েছে পলিথিনের অবদান, যা থেকে ভূমিকম্প, বজ্রপাত, আল্ট্রা ভায়োলেট রেডিয়েশনের মতো ঘটনা ঘটছে। ২০১৭ সালে পাট ও পাটজাত বর্জ্যের সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ উদ্ভাবন করেছে পরমাণু শক্তি কমিশনের খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ড. মুবারক আহমদ খান। সম্পূর্ণরূপে পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব এ ব্যাগ পানিতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত টিকে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে গলতে শুরু করে। ক্ষতিকর কোনো কেমিক্যাল এতে ব্যবহার না করায় পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যেই মাটিতে মিশে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। ফলে পরিবেশ দূষিত হবে না, সৃষ্টি করবে না জলাবদ্ধতা। সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৫০০ বিলিয়ন পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশে যে পরিমাণ পাট উৎপাদিত হয়, তার পুরোটা এ খাতে বিনিয়োগ করলে তা দিয়ে বিশ্ব চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ পূরণ করা সম্ভব।

সরকারি উদ্যোগ : পরিবেশ রক্ষায় সার, চিনি, ধান, চালসহ ১৭টি পণ্য বিক্রয়, বিতরণ ও সরবরাহে বাধ্যতামূলক পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ প্রণীত হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের মোড়ক হিসেবে ৭৫ শতাংশ পাট আছে এমন উপাদান দিয়ে তৈরি মোড়ক ব্যবহারের বিধান রাখা হয়েছে। পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন-২০১০ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে বার্ষিক পাটের ব্যাগের চাহিদা ৯০ হাজার পিস থেকে বেড়ে ৮৪ কোটি পিসে উন্নীত হবে। পাটকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারে (জেডিপিসি) ১৩৫ প্রকার বহুমুখী পাটপণ্যের স্থায়ী প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র চালু হয়েছে। বহুমুখী পাটপণ্য তৈরির কাঁচামাল জোগান দিতে পদ্মার ওপারে ২০০ একর জমির ওপর দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পাটপল্লী প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads