একই প্রতিষ্ঠানে কাজের সুবাদে শান্ত ধীরস্থির স্বভাবের ধর্মভীরু ফারহানাকে দেখে পছন্দ হয় মনিরের। বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয় বাসায়। মনিরের মধ্যেও ফারহানা দেখেছিলেন আদর্শ স্বামীর কিছু গুণাবলি। এরপর পারিবারিকভাবেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছিল। ধর্মীয় বিধিনিষেধের প্রতি দুজনই ছিলেন শ্রদ্ধাশীল এবং মেনেও চলতেন তা। তাই বিয়ের পর থেকেই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে স্বামীর অপছন্দের বিষয়গুলোর প্রতি বেশ সতর্ক থাকতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে যত দিন যেতে থাকল, যুক্ত হলো অযৌক্তিক কিছু বাধ্যবাধকতা। প্রতিনিয়ত প্রতিটি বিষয়ে তার নিজস্ব নিয়মকানুন আর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ করাও সে পছন্দ করে না। আর এ সবকিছুর পেছনে থাকে কোনো না কোনো ধর্মীয় ব্যাখ্যা। নানা সময় কাজে ভুল ধরে বিভিন্নভাবে তাকে ছোট করার চেষ্টা তো রয়েছেই। বিষয়গুলো ফারহানার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠছে, ভেঙে পড়ছে মানসিকভাবে। এ নিয়ে প্রায়ই সংসারে অশান্তি হয়। কিন্তু ফারহানা কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছে না। কারণ সে নিজেই বুঝে উঠতে পারে না মানুষটিকে। যে মানুষটি তাকে অকথ্য ভাষায় বকাঝকা করছে, সে মানুষটিই পরক্ষণে তার কাছে ভালোবাসা প্রকাশে বা সাংসারিক কাজে তাকে সহযোগিতা করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। স্বামীর এমন দ্বিমুখী আচরণে ফারহানা সবসময়ই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে।
ফারহানার মতো এমন অনেক নারীই আছেন, যারা প্রতিনিয়ত সঙ্গীটির কাছ থেকে এমন আচরণ পেয়ে আসছেন। কিন্তু তাদের অনেকেই জানেন না তিনি পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এটি পারিবারিক নির্যাতনের এক ভিন্ন ধরন।
কখন বুঝবেন আপনি নির্যাতনের শিকার
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতনকারীর কৌশলী আচরণের কারণে নির্যাতনের শিকার নারীটি বুঝে উঠতে পারেন না তিনি নির্যাতিত হচ্ছেন। তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য সঙ্গীটি প্রতিনিয়ত তার আচরণ বদলাতে থাকেন। এর মধ্যে কী করে বুঝবেন আপনি নির্যাতনের শিকার?
যখন দেখবেন আপনার সঙ্গীটি আপনার জীবনের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে, আপনার পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়-পরিজনের বাসায় যাওয়া কিংবা তাদের আপনার বাড়িতে আসা অপছন্দ করছেন। অর্থাৎ আপনার চেনা জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে ধীরে ধীরে। কথায় কথায় হত্যা বা বিচ্ছেদের হুমকি দিচ্ছে। কারণে অকারণে হেয় করে বা ছোট করে কথা বলছে। তখনই আপনাকে সচেতন হতে হবে। কারণ আপনি পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পারিবারিক নির্যাতন মানে শুধু শারীরিক নির্যাতন বুঝি আমরা। ফলে প্রতিনিয়ত মানসিক নির্যাতনের এ বিষয়গুলো আমলে নিই না। অথবা বুঝতে পারলেও সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে, লজ্জায়, অক্ষমতায় নীরব থাকার সিদ্ধান্ত নিই। ফলে নীরব এ নির্যাতন চলতেই থাকে, নির্যাতিত মানুষটিও নিষ্পেষিত হতে থাকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। অথচ দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ একসময় হতাশা, বিষণ্নতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কারণে পরিণত হয়। পারিবারিক নির্যাতনের রয়েছে আরো কিছু ধরন। মিলিয়ে নিন আপনার নিজের সঙ্গে নিচের কোনো একটি বিষয় ঘটছে কি-না।
নির্যাতনের ধরন
· নারীর যে কোনো অর্জন, সাফল্য এবং স্বপ্নের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা।
· নিজের ইচ্ছামতো নারীর ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ বা বদলানোর চেষ্টা করা।
· সবসময় নিজেকে সঠিক আর নারীকে ভুল প্রমাণ করা।
· বার বার তার ভুল-ত্রুটি বা অক্ষমতা নিয়ে কথা বলা।
· প্রতিনিয়ত নারীকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা। এমনকি অর্থনৈতিকভাবেও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা।
· নারীর মতামত, ইচ্ছা, প্রয়োজন, বুদ্ধি, আদর্শ, মনোভাব, আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদিকে তুচ্ছ ও খাটো করা।
· নিজের সমস্যা, অশান্তি আর জীবনের প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদির জন্য নারীকে দোষারোপ করা।
· নারীর প্রতি উদাসীনতা এবং তাকে অগ্রাহ্য করা।
· একান্তে বা অন্যের সামনে সঙ্গিনীটিকে অপমান বা ছোট করা।
· নারীর প্রতি সহমর্মিতা, সমবেদনা না থাকা। যেমন অসুস্থতার সময় বিরক্তি প্রকাশ করা, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে অনীহা ইত্যাদি।
· অনুমতি ছাড়া নারী কোনো কাজ করতে পারে না।
· গালিগালাজ করা, অপমানসূচক সম্বোধন করা।
· নারীর পরিবার নিয়ে তাকে নিচু করার জন্য নেতিবাচক কথা বলা।
সাইকেল অব অ্যাবিউজ
পারিবারিক নির্যাতনের এ ধরনটি একটি সাইকেলের মতো সংগঠিত হতে থাকে। সমাজবিজ্ঞানী লেনর ওয়াকার প্রায় ১৫০০ ভিকটিমের ওপর একটি স্টাডি করেন। এ স্টাডি থেকে তিনি ‘সাইকেল অব অ্যাবিউজ’ থিওরি প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন পারিবারিক নির্যাতনের এ ধরনটি চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। এই থিওরিটিকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে- ১. সম্পর্কে চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি, ২. নির্যাতনের ঘটনা, ৩. মিটমাট পর্ব, ৪. প্রশান্তিকাল।
1. প্রথম পর্বে দুজনের মধ্যে কিছু একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে একটা চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে আপনার কোনো কাজে অসন্তুষ্ট সঙ্গীটি তার অসন্তোষের কারণ স্পষ্ট না করে তার নানা আচরণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়। হয়তো সামান্য কারণে অথবা কোনো কারণ ছাড়াই সঙ্গীটির ওপর রেগে যায় বা কথা বলা বন্ধ রাখে। এ চাপা ক্ষোভ নির্যাতিত ব্যক্তিটির ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। এতে সে খুব নার্ভাস হয়ে যায় এবং আসন্ন বড় কোনো বিপর্যয়ের ভয়ে আতঙ্কিত থাকেন।
2. দ্বিতীয় পর্যায়টি সবচেয়ে মর্মান্তিক, যখন নির্যাতনের মূল ঘটনাটি ঘটে। গায়ে হাত না তুলেও ভীতি প্রদর্শন, চাপ প্রয়োগ, অপদস্থ করা, শাস্তি দেওয়া বা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন করা। এক্ষেত্রে অত্যাচারিতকে নীচু করে, অপমান করে বা ভয় দেখিয়ে নারীকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা।
3. এই ধাপটিকে নির্যাতন চক্রের ইতিবাচক ধাপ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, যেটিকে তিনি মিটমাট পর্যায় বা মধুচন্দ্রিমা পর্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ ধাপটিতে নির্যাতনকারী তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায় এবং এ ধরনের ব্যবহারের পুনরাবৃত্তি হবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দেয়। তার জীবনে আপনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে নির্যাতিত ব্যক্তিটি নিজেকেই অপরাধী ভেবে মিটমাট করার জন্য নির্যাতনকারীর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে।
4. শেষ পর্যায়টিতে এসে বেশ কিছুদিন নির্যাতন বন্ধ থাকে। পারিবারিক পরিবেশ এমন থাকে যে, বেশ সুখী পরিবার এটি। এ ধরনের মানসিক নির্যাতন বন্ধ থাকে বলে একপর্যায়ে নির্যাতিত নারীটি বিশ্বাস করতে চায় যে আসলেই সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নির্যাতনের চাকা ঘুরে আবার প্রথম পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয় এবং এ নির্যাতন চক্র চলতেই থাকে।
এই নির্যাতন চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্য নির্যাতিত ব্যক্তিকেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। এজন্য সবচেয়ে জরুরি হলো নিজের ওপর আস্থা রাখা, নিজের ভেতরের শক্তিকে অনুধাবন করতে পারা, নিজের আত্মমর্যাদাকে গুরুত্ব দেওয়া। কেননা আপনি যদি নিজের একটি বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে না পারেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না জানেন, তাহলে এ ধরনের নির্যাতন মেনে নিতে হবে।