নারীর জয়ে মনুষ্যত্বের জয়

নারীর জয়

প্রতীকী ছবি

ফিচার

নারীর জয়ে মনুষ্যত্বের জয়

  • মুনযির আকলাম
  • প্রকাশিত ২৩ মার্চ, ২০১৯

মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে নারী পরিবার, সমাজ, দেশ কিংবা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই সভ্যতা বিকাশে নারীর ভূমিকা অপরিসীম। যুগে যুগে নারীরা সময়ের মাইলফলক হিসেবে অবদান রেখে চলেছেন। মানবতাবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের নিচের অবৈষম্যমূলক স্তবকটি পৃথিবীর সব মানুষের জন্য এক অনুপ্রেরণার পাথেয় ‘বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’ (‘নারী’, ‘সাম্যবাদী’ নজরুল রচনাবলী, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪৩)। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রশ্নে বাঙালি চিন্তানায়ক বঙ্কিমচন্দ্র তার ‘সাম্য’ গ্রন্থে ঘোষণা করেছিলেন- ‘মনুষ্যে মনুষ্যে সমানাধিকারবিশিষ্ট, স্ত্রীগণও মনুষ্য জাতি, অতএব স্ত্রীগণও পুরুষের তুল্য অধিকারশালিনী, যে যে কার্য্যে পুরুষের অধিকার আছে, স্ত্রীগণেরও সেই সেই কার্য্যে অধিকার থাকা ন্যায়সঙ্গত।’ (বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, ৯ম মুদ্রণ, সাহিত্য সংসদ ১৩৯২, পৃ. ৩৯৯)। পৃথিবীর সব প্রাচীন ও আধুনিক সভ্যতা এবং সমাজব্যবস্থা এ বিষয়ে একমত যে, মানবসমাজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যে কোনো মূল্যে পারিবারিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা অপরিহার্য।

সেই সঙ্গে প্রাচীন ও আধুনিক সব সমাজবিজ্ঞানী এটাও স্বীকার করেন যে, নারীই হলো পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। পরিবারব্যবস্থা ভেঙে পড়ার অর্থই হলো সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়া, আর সমাজব্যবস্থা যখন ভেঙে পড়ে তখন সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। প্রাচীন সভ্যতার ক্ষেত্রেও এটা হয়েছে, আধুনিক সভ্যতার ক্ষেত্রেও তা হতে পারে। নারী-পুরুষের কথা, মানুষের এই সাম্যের কথা Gendered Lives (3rd ed. Wordsworth Publication Company, NY, 1998) -এর লেখায়ও প্রতিধ্বনিত হতে দেখা যায়, যিনি ফ্যামিনিজমকে ব্যাপক পরিসরে দেখেছেন।

সমাজপ্রগতির লক্ষ্যে নারীর অবরোধ প্রথার বিলোপসহ তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈষম্যের পরিবর্তন দরকার। নারীকে যথাযোগ্য সম্মান ও অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করতে তাদের প্রাপ্য মর্যাদাকে কখনোই অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। নারীকে সমাজে স্বাধীন, সুস্থ, নিরাপদ ও সুন্দরভাবে আত্মসম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার পথপ্রদর্শন করতে হবে আমাদেরই। নারী আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় মা আর মমতাময়ী মায়ের মর্যাদা সবার উপরে। একটি সন্তানের লালনপালন, সার্বিক প্রতিপালন, সঠিক ব্যক্তিত্ব গঠন এবং বিশুদ্ধ মানসিকতা তৈরিতে বাবার চেয়ে মায়ের দায়িত্ব, অবদান ও কৃতিত্ব অনেক বেশি। যে নারী আমাদের পথ চলতে শিখিয়েছেন, তিনি আমাদের মা। আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যই নিজের অনেক শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছেন তিনি। নারী আমাদের প্রেমময় স্ত্রী আর স্ত্রী অত্যন্ত গভীর বিশ্বস্ত বন্ধুত্ব ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ অংশের হকদারসহ তারা আমাদের পরিচ্ছেদ। নারী আমাদের কন্যা আর কন্যারা সবসময়ই আমাদের পরম স্নেহের, প্রিয় কলিজার টুকরো এবং নারী আমাদের আদরের বোন। আমাদের ভাবা উচিত এবং ভুলে গেলে চলবে না যে, পথে যে মেয়েরা চলছে, ওরাও কারো মা, কারো স্ত্রী, কারো মেয়ে, কারো বোন। দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে, আমাদের সমাজের নারীদের বেশ বড় সংখ্যাই বঞ্চিত নারী অধিকার থেকে। তাদের যাতে রাস্তাঘাটে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন না হতে হয়। নারী ছাড়া বা নারীর সক্রিয় উপস্থিতি ছাড়া একটি সুন্দর, ভারসাম্যপূর্ণ ও সৃজনশীল সমাজ আশা করা যায় না। নারীকে মানুষ এবং নারী এই দুই হিসেবেই সম্মান করতে শিখি আমরা।

নারীকে শুধু সামাজিক মর্যাদা দিলেই হবে না, দিতে হবে ন্যায়সঙ্গত অর্থনৈতিক অধিকারও। তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে। মানবসভ্যতায় নারী-পুরুষ উভয়েরই প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সম-অধিকার স্বীকৃত। তা ছাড়া সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ কনভেনশন গৃহীত হয়। প্রয়োজনীয় সংখ্যক রাষ্ট্রপক্ষের অনুমোদনের মধ্য দিয়ে ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কনভেনশনটি কার্যকারিতা লাভ করে।

নারীর জয় মানে পুরুষের পরাজয় নয়, নারীর জয় মানে মনুষ্যত্বের জয়। নারীকে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে না করে একে অন্যের পরিপূরক মনে করে সর্বোপরি নারীর মর্যাদা, অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মাতৃত্বের গৌরব অর্জন করার জন্য পৃথিবীর প্রতিটি নারীকে প্রতিবার জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে হয়, তাই নারী এত মহীয়ান।

 

লেখক :  প্রাবন্ধিক

moonzeerahcklham@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads