মানুষ ভাবো, নারী নয়

মানুষ ভাবো, নারী নয়

প্রতীকী ছবি

ফিচার

মানুষ ভাবো, নারী নয়

  • সোলায়মান মোহাম্মদ
  • প্রকাশিত ২৩ মার্চ, ২০১৯

বর্তমান সময়ে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে নারীদের অবাধ বিচরণ। দিন যত পার হচ্ছে, আমাদের মেয়েরা তত সমৃদ্ধ হচ্ছে। সমাজসেবা থেকে শুরু করে উন্নয়নমূলক সব ধরনের কাজেই নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের থেকে কোনো অংশে কম নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং বেশিই অবদান রাখছে নারীরা। কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, নারীরা একবিংশ শতাব্দীর এই যুগে পুরুষের চেয়ে প্রায় অনেক দিক থেকেই এগিয়ে রয়েছে। এই যে নারীরা সব ক্ষেত্রেই তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখছে, দেশ পরিচালনা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পরিসরেও কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে, ইসলাম ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল-কোরআনেও নারীর অবস্থান ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়েছে- তাহলে প্রশ্ন হলো নারী কেন আজো লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, অবহেলিত ও নির্যাতিত? কেন আজো নারীরা সমাজের চোখে খাটো? দেশের এমন কোনো সংবাদপত্র নেই, যেখানে প্রতিদিন কোনো নারীর অসহায়ত্বের কথা উল্লেখ করা হয় না। যেন সংবাদপত্রের নির্দিষ্ট কিছু পেজ বরাদ্দ করা রয়েছে। নারীদের পক্ষে আইনের পর আইন হচ্ছে। একের পর এক চাওয়া ও দাবি বাস্তবায়ন হচ্ছে কিন্তু তবু নারীদের ওপর নির্যাতন থামছে না। কী করা প্রয়োজন? কী করলে নারীদের আর দুর্বল ভাবা হবে না? প্রকৃতপক্ষে আমাদের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন করতে হবে। যত সুবিধাই নারীদের জন্য সৃষ্টি করা হবে, ততই সমস্যার সৃষ্টি হবে।

একটি প্রবাদ আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। নারী-পুরুষ সমান অধিকার আইন করা হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার উল্টোও রয়েছে। রীতিমতো দ্বিমুখী আইন। যদি নারী-পুরুষ সমান অধিকার হয় তবে সরকারি চাকরিতে নারীদের ওমুক কোটা তমুক কোটা, এই সুবিধা সেই সুবিধা কেন? নারীবাদীরা বলছেন নারীদের মানুষ ভাবো, নারী নয়। আমিও তা-ই বলি- নারীদের মানুষ ভাবো, নারী নয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সম্পূর্ণ তার উল্টো। নারী কোটা করে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হলো এরা নারী, এরা দুর্বল। এদের জন্য তো আলাদা কোটা থাকবেই। যানবাহনে চড়বে, সেখানেও একই কাহিনি, নারীদের জন্য আলাদা সিট বরাদ্দ। গাড়ির সামনের সিটে কোনো পুরুষ বসতে পারবে না, সেখানে নারী নামক ভিনগ্রহের কোনো প্রাণী বসবে। স্কুল-কলেজের সিলেবাসে নারী-পুরুষ বৈষম্যের রচনা থেকে শুরু করে একাধিক পাঠ্যসূচি রয়েছে। এগুলো বার বার পড়ানো হচ্ছে আর কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে বৈষম্যের বিষয়টি। একরকম মেয়ে শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষেত্রে মাইন সেটআপ করে দেওয়া হচ্ছে পরিবার ও স্কুল থেকে। স্কুল-কলেজের বার্ষিক শিক্ষা সফরে মেয়েদের স্কুল থেকেও নেওয়া হচ্ছে না, পরিবার থেকেও দেওয়া হচ্ছে না। কারণ হলো এরা নারী। ইরানের কবি হাকিম ওমর খৈয়াম বলেছিলেন- জ্ঞানার্জন দুভাবে হয়, একটি হলো বই পড়ে; অন্যটি ভ্রমণ করে। বই পড়ে জ্ঞানার্জনের চেয়ে ভ্রমণ করে জ্ঞানার্জনের বিষয়টি অধিক স্থায়িত্বের। অন্যদিকে সরকারিভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা সফর বাধ্যতামূলক করা হলেও তা যেন শুধু ছেলে শিক্ষার্থীদের জন্য। এখানেও বৈষম্যের শিকার মেয়েরা। ভ্রমণের জ্ঞান যেন মেয়ে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন নেই।

এবার আসুন বিয়ের ক্ষেত্রে। ছেলেরা হাজারটা মেয়ে দেখে একটি বিয়ে করে। ছেলেপক্ষ আসবে মেয়েদের বাড়িতে। সকাল থেকেই বাহারি আয়োজন। মেয়েকে শতরূপে সাজিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে হাজির করা হয়। আর ছেলেপক্ষের মেহমানরা মেয়ের মাথার চুল থেকে শুরু করে সব দেখার পর হঠাৎ মনে হয়- ওহ্, মেয়েটা কীভাবে হাঁটে তা তো দেখা হলো না! মা জননী একটু হেঁটে দেখান তো। সবশেষে মেয়ের হাতে টাকা দিয়ে যান। বিষয়টি হলো এমন যে, বাজারে একটি পণ্য ক্রয় করতে যাওয়া হয়েছে, অনেক দেখার পর পণ্যটি হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে, এখন জরিমানা দিয়ে আসতে হবে। আধুনিকতার চরম উৎকর্ষে অবস্থান করেও আমাদের সমাজের এটাই বাস্তব চিত্র।

সুতরাং নারীদের পক্ষে আইন করে বিভিন্ন কোটা ব্যবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে নারীদের দুর্বল হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কাজ বলেই মনে করি। বাঘের ভয়ে নিজে খাঁচার ভেতর সারাক্ষণ বসে না থেকে বাঘ তাড়ানোর ব্যবস্থা করাই যেমন বুদ্ধিমানের কাজ, তেমনি নারীদের অপশক্তির হাত থেকে রক্ষার করার জন্য শুধু নারীদের সমাজ, দেশ ও শিক্ষামূলক বিভিন্ন কাজ থেকে দূরে সরিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখলে চলবে না, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের আরো সংশোধনী নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের দেশের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আর এই আইন নারীদের পক্ষে নয় বরং সভ্যতার পক্ষে, অন্যায়কারীদের বিপক্ষে হবে। যতদিন পর্যন্ত নারীদের নারী বানিয়ে রাখা হবে, ততদিন নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ হবে না। দিবসের পূজারি হলে চলবে না। প্রকৃতপক্ষে মানুষ যারা, তাদের কাছে মা-বোনের সম্মান কোনো নির্দিষ্ট দিনক্ষণে সীমাবদ্ধ থাকে না। কাজেই সবার আগে যেটি ভাবতে হবে, সেটি হলো আমরা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। সবাইকে ভাবতে হবে- নারী তুমি মানুষ আগে, পরে নারী। যেখানে লিঙ্গবৈষম্যের কোনো সুযোগ নেই।

 

লেখক : সাংবাদিক

ংঁষধুসধহংরৎ৮৭—মসধরষ.পড়স

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads