নরসিংদীতে গর্ডিয়ান নটে নারীসহ দুইজন নিহত

নরসিংদীর মাধবদীর শেখেরচরে দীঘীরপাড় এলাকায় জঙ্গী আস্তানা পরিদর্শনশেষে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেনিআইজিপি

ছবি : বাংলাদেশের খবর

অপরাধ

নরসিংদীতে গর্ডিয়ান নটে নারীসহ দুইজন নিহত

  • সুমন বর্মণ (নরসিংদী) ও সুমন পাল (মাধবদী)
  • প্রকাশিত ১৭ অক্টোবর, ২০১৮

নরসিংদী সদর উপজেলায় সন্দেহভাজন জঙ্গিদের দুটি আস্তানার একটিতে পরিচালিত অপারেশন সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে উপজেলার শেখেরচরের ভগীরথপুর এলাকার ‘নব্য জেএমবির আস্তানা’য় পরিচালিত সোয়াটের অপারেশন ‘গর্ডিয়ান নট’ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। অপারেশন শেষে ঘটনাস্থল থেকে দুই নারী-পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। অপারেশন সমাপ্ত ঘোষণা করা হলেও ওই এলাকা ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটপ্রধান মনিরুল ইসলাম।

অন্যদিকে, সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মাধবদী ছোট গদাইরচর গাংপাড় এলাকার অপর আস্তানা ঘিরে রেখেছিল পুলিশ।

ভগীরথপুরের পাঁচতলা ভবনে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শেষে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, অভিযানে নিহতদের মধ্যে একজন পুরুষ ও একজন নারী। তারা নব্য জেএমবির সদস্য। প্রাথমিকভাবে তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গত ৩ অক্টোবর এখানে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল তারা। গাংপাড় এলাকার জঙ্গিদের সঙ্গে ভগীরথপুরের জঙ্গিদের যোগসাজশ রয়েছে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসিপ্রধান বলেন, নিহতরা পুলিশের গুলিতে মারা গেছে, নাকি নিজেরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মহত্যা করেছে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি বলেন, গাংপাড় এলাকার আস্তানায়ও দিনের আলোতে অভিযান চালানো হবে। তাদেরও আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হবে। আত্মসমর্পণ না করলে আমরা অ্যাকশনে যাব।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল, দুর্গাপূজা এবং সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে জঙ্গিরা বড় ধরনের নাশকতার জন্য সংগঠিত হচ্ছে। তারা কোথায় হামলা চালাতে পারে সে বিষয়ে সঠিক তথ্য ছিল না। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নজরদারি বাড়িয়ে জঙ্গি আস্তানা দুটির সন্ধান পাওয়া যায়।

এদিকে জঙ্গি আস্তানার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। সকালেই জঙ্গি আস্তানা দুটির আশপাশের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। সকাল থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে জোরদার করা হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ফলে আশপাশের বাসার অনেকে জিম্মি হয়ে পড়েন। যারা ভোরে বাসা থেকে বের হয়েছেন তাদের অনেকে বাসায় ফিরতে পারছিলেন না।

সোমবার রাত ১০টার পর বাড়ি দুটি ঘিরে রাখে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরা। ভোর ৬টার দিকে আস্তানা দুটির আশপাশ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। সরিয়ে নেওয়া হয় এলাকার বাসিন্দাদের। শেখেরচর ভগীরথপুর চেয়ারম্যান মার্কেটের পাশের পাঁচতলা ভবনে সকাল ১০টার পর অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই বাড়ির মালিক বিল্লাল মিয়া। তিনি ডাইং ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। ইভা টেক্সটাইল মিলেরও মালিক তিনি।

মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। সকাল ৯টা ৫৩ মিনিটে শেখেরচর ভগীরথপুর চেয়ারম্যান মার্কেটের পাশে অবস্থিত ঘটনাস্থলে আসেন সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। রাতেই সেখানে আসেন পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। জেলা পুলিশ, অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট, সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, সোয়াট এবং সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অন্যান্য ইউনিটের সদস্যরা একে একে ঘটনাস্থলে আসেন। অভিযান শুরুর পর দিনভর থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা যায়। জঙ্গিরা বাসার ভেতর থেকে এবং পুলিশ বাইরে থেকে জঙ্গিদের লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করে এবং চারটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে দুপুর সাড়ে ১২টার পর আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী সাংবাদিকদের জানান, অপারেশনের প্রটোকল অনুযায়ী যেসব ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার সেসব ব্যবস্থা নিয়েই অপারেশন পরিচালনা করছি। জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সে সুযোগ নেয়নি। এরপর গুলিবর্ষণের মধ্য দিয়ে মূল অপারেশন শুরু করা হয়।

অপারেশনের নাম ‘গর্ডিয়ান নট’ দেওয়ার কারণ হিসেবে আইজিপি বলেন, নট মানে হচ্ছে গিঁট। এটা এমন জটিল গিঁট, যা খুলতে কষ্ট হয়। অপারেশনটা খুব জটিল। এখানে পুলিশের চেয়ে জঙ্গিরা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। সুতরাং আমাদের জন্য অপারেশনটা একটু কষ্টকর।

গাংপাড়ের জঙ্গি আস্তানা বিষয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, মাধবদী পৌরসভার গাংপাড় এলাকার আফজাল হাজীর ‘নিলুফা ভিলা’ নামের সাততলা একটি বাড়িতে তিন জঙ্গিকে সোমবার রাত থেকে ঘিরে রাখে সিটিটিসি সদস্যরা। ওই ভবনের তৃতীয় তলায় ‘মিততাহুল জান্নাহ মহিলা মাদরাসা’ নামে একটি মাদরাসা আছে। ভবনটির সাততলায় জঙ্গিদের অবস্থান চিহ্নিত করে পুলিশ। সকালে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, নিলুফা ভিলায় তিন জঙ্গি অবস্থান করছে। এদের মধ্যে দুজন নারী ও একজন পুরুষ রয়েছে।

স্থানীয়রা জানায়, ‘নিলুফা ভিলা’র ওই ফ্ল্যাটটি গত ছয় মাস আগে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার বাসিন্দা হাফিজ ভূইয়া নামে এক ব্যক্তি ভাড়া নেন। সোমবার রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সেখানে গেলে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে বাসার ভেতর থেকে লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়।

মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে শেখেরচর ভগীরথপুর চেয়ারম্যান মার্কেট এলাকার বাসিন্দা বাদল মিয়া ওরফে বাদল বাবুর্চি জানান, সকালে জঙ্গি আস্তানার পাশের বাড়ি থেকে নাজমুল (১৭) নামে একজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে জানা যায়, নাজমুলের মাধ্যমেই জঙ্গিরা বাড়িটি ভাড়া নেয়। নাজমুল শেখেরচর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মুদি দোকানদার। এলাকায় সে খুবই ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত।

বাদল আরো জানান, নাজমুলের এক বোনের দেবর ওই জঙ্গিদের ব্যবসায়ী পরিচয়ে নাজমুলের কাছে নিয়ে আসে। পরে নাজমুলের মাধ্যমে বিল্লাল মিয়ার ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় জঙ্গিরা। তিনি জানান, জঙ্গি আস্তানার সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই আতঙ্কের মধ্যে আছি।

ছোট গদাইরচর গাংপাড় এলাকার নিলুফা ভিলার পাশের বাড়ির বাসিন্দা ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন ওরফে আনোয়ার কমিশনার জানান, আমার বাড়ির ঠিক ১০০ গজ দূরে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু এখানে জঙ্গি থাকার বিষয়টি আগে কখনো ভাবতেও পারিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads