ধান সুপারি আর ইলিশের দেশ

হিমালয় থেকে নেমে আসা তিনটি প্রধান নদীর পলি দিয়ে মোহনায় গড়ে উঠেছে এ দ্বীপ

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

ধান সুপারি আর ইলিশের দেশ

  • ভোলা প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১৬ অক্টোবর, ২০১৮

গাঙ্গেয় অববাহিকার নিম্নাঞ্চলে অবস্থিত দেশের একমাত্র দ্বীপ ভোলা। একসময় ভোলাকে বলা হতো ধান সুপারি ইলিশের দেশ। এখন সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে গ্যাসসমৃদ্ধ স্বর্ণদ্বীপ ভোলা। বর্তমান ভোলা একদা বৃহত্তর বরিশাল জেলার একটি মহকুমা ছিল। ১৮৫৪ সালে দ্বীপটি মহকুমায় উন্নীত হয়। ১৯৮৪ সালে মহকুমা থেকে জেলার মর্যাদা লাভ করে। ভোলার আদি নাম ছিল দক্ষিণ শাহবাজপুর। চারদিকে নদী পরিবেষ্টিত এ জনপদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য আবহমান বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতোই। ভোলা জেলায় সংসদীয় আসন ৪টি, উপজেলা ৭ টি, পৌরসভা ৫টি, ইউনিয়ন পরিষদ ৬৬টি। জেলার আয়তন ৩৪০৩ দশমিক ৪৮ বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা ২০ লাখ ৩৭ হাজার ২০১ জন। এলাকার কিংবদন্তি, মসজিদ-মন্দিরের স্থাপত্য ও নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন বিশ্লেষণ করলে অনুমিত হয় এ জনপদ ৭-৮শ’ বছর আগে সভ্যতার আলোকপ্রাপ্ত হয়েছে। মহারাজা কন্দর্প নারায়ণের কন্যা বিদ্যাসুন্দরী ও কমলা রানীর দীঘির ইতিহাস এ অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির একটি অংশ। এ দীঘির কাহিনী নিয়ে সুদূর তামিলনাড়ুর নিম্নাঞ্চলে এখনো গান পরিবেশিত হয়। মেঘনা, তেঁতুলিয়া বিধৌত বঙ্গোপসাগরের উপকূলে জেগে ওঠা প্রায় ৯০ মাইল দৈর্ঘ্য ও ২৫ মাইল প্রস্থের এ ভূখণ্ডের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো যেদিকে চোখ যায় সব দিকে শুধু সমতল ভূমি। ফসলের দোলায়মান দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ দেখে মানুষের মনে জেগে ওঠে বাউলের গান ও রাখালের বাঁশিতে ভর করে মোহনীয় সুর। প্রাকৃতিক সুষমামণ্ডিত এ এলাকার গাছ-গাছালি, পাখির কুজন বারোমাসী ফলমূল উল্লেখযোগ্য।

হিমালয় থেকে নেমে আসা তিনটি প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রবাহিত পলি দিয়ে মোহনায় গড়ে উঠেছে এ দ্বীপ। সমুদ্র সমতল থেকে এর গড় উচ্চতা ১২ ফুটের মতো। নৃতত্ত্ব ও ভূতত্ত্ববিদরা মনে করেন, ‘পূর্ব দিকে মেঘনা ও পশ্চিম দিকে তেঁতুলিয়া নদী বঙ্গোপসাগরের মোহনায় এসে গতিবেগ হারিয়ে ফেলে। ফলে এ স্থানটিতে কালক্রমে পলি ও নদীতে বয়ে আসা বর্জ্য জমা হয়ে আজকের ভোলা নামক দ্বীপটির জন্ম।’

ভোলার জন্ম খুব বেশি দিনের নয়। আনুমানিক ১২৩৫ সালের দিকে দ্বীপটি গড়ে উঠতে শুরু করে। এখানে প্রথম চর পড়া শুরু হয় ১২৩৫ সালের দিকে এবং ১৩০০ সালের দিকে চাষাবাদ শুরু হয় বলে জে.সি. জ্যাক বাকেরগঞ্জ গেজেটিয়ারে উল্লেখ করেন। এলাকার ধান, চাল, সুপারি, নারিকেল ও অন্যান্য ফসলের প্রাচুর্যে প্রলুব্দ হয়ে একের পর এক বিদেশি শাসক ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা এসেছে এখানে। ১৫০০ সালের দিকে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের নজর পড়ে এ দ্বীপটির ওপর। তারা দ্বীপটিকে ঘাঁটি বানিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বিঘ্নে লুটপাট চালিয়ে যেতে থাকে। এ ছাড়াও আরাকানের বর্গি ও মগরা দক্ষিণ শাহবাজপুরসহ আশপাশের দ্বীপকে ঘাঁটি বানিয়ে লুটপাট চালিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করে রাখত। ১৫১৭ সালে জন ডি সিলবেরা নামক জনৈক পর্তুগিজ জলদসু্যু দ্বীপটি দখল করে। পর্তুগিজদের রেখে যাওয়া ভীমদর্শন কিছু রোমশ কুকুর আজো দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে সেসব লোমহর্ষক অত্যাচারের কাহিনী স্মরণ করিয়ে দেয়। বলাবাহুল্য মনপুরা ছিল এদের দস্যুবৃত্তির লীলাক্ষেত্র।

১৮ শতকে দক্ষিণ শাহবাজপুরের আয়তন ছিল মাত্র ২৫২ বর্গমাইল। ১৮২২ সাল পর্যন্ত শাহবাজপুর ছিল বাকেরগঞ্জ জেলার অংশ। উনিশ শতকের প্রথম ভাগে মেঘনার শাখা ইলিশা ও তেঁতুলিয়া বৃহত্তর আকার ধারণ করে। ফলে ভয়ঙ্কর কালাবঁদর নদী পাড়ি দিয়ে নৌকাপথে জেলা সদর দফতরের সঙ্গে দক্ষিণ শাহবাজপুরের যোগাযোগ রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই তৎকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নেয় বাকেরগঞ্জ হতে দক্ষিণ শাহবাজপুর ও হাতিয়াকে নোয়াখালীর অন্তর্ভুক্ত করার। ১৮২২ সালের ২২ এপ্রিল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দক্ষিণ শাহবাজপুরকে নোয়াখালীর অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেন এবং ওই বছর ৩ জুলাই নোয়াখালীর জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট এইচ. পারকার দক্ষিণ শাহবাজপুরের দায়িত্ব বুঝে নেন। ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত ভোলা নোয়াখালীর অধীনে ছিল। ভোলা জেলার নামকরণের পেছনে স্থানীয়ভাবে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। ভোলা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বেতুয়া নামক খালটি এখনকার মতো অপ্রশস্ত ছিল না। একসময় এটি পরিচিত ছিল বেতুয়া নদী নামে। খেয়া নৌকার সাহায্যে নদীতে পারাপার চলত। খুব বুড়ো এক মাঝি এখানে খেয়া নৌকার সাহায্যে লোকজন পারাপার করতেন। তার নাম ছিল ভোলা গাজী পাটনী। আজকের যোগীরঘোলের কাছেই তার আস্তানা ছিল। এই ভোলা গাজীর নামানুসারেই একসময় স্থানটির নাম হয় ভোলা। ভোলার অন্যান্য উপজেলাও বিভিন্ন ব্যক্তির নামে নামকরণ করা হয় যেমন- দৌলতখাঁ, তজুমুদ্দিন, বোরহানউদ্দিন ও লালমোহন।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads