কোনটি গুরুত্ব দেবেন কর্মজীবী নারী - অফিস নাকি বাড়ি

কর্মজীবী নারীটিকে প্রতিনিয়ত অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যেতে হয়

প্রতীকী ছবি

ফিচার

কোনটি গুরুত্ব দেবেন কর্মজীবী নারী - অফিস নাকি বাড়ি

  • মনিরা তাবাস্সুম
  • প্রকাশিত ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

চিত্র-১ : রাত ১টা। রান্নাঘরে ঘাম মুছতে মুছতে রুটি বেলছেন তিনি। মাঝে মাঝে উঠে দেখে নিচ্ছেন চুলায় চড়ানো ভাজিটা কড়াইয়ের তলায় লেগে যাচ্ছে কিনা। একই সঙ্গে মাথায় তখন চলছে বুয়াকে দিয়ে সকালে কী কী কাজ করিয়ে রাখতে হবে, সে ভাবনা। এই হলো হীমি রহমানের নিত্যদিনের রাতের চিত্র। তিনি একজন কর্মজীবী নারী। অফিসে বিশাল দায়িত্ব তার কাঁধে; অন্যদিকে তিন বছর বয়সী মেয়ের মা আর শ্বশুরবাড়ির বড় ছেলের বউ হওয়ায় পরিবারে দায়িত্বটাও নিতান্ত কম নয়। রোজ রাতেই তাই পরদিন সকালের কাজ অনেকটাই গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। তারপরও সারাক্ষণ মনে এক অস্বস্তি কাজ করে। কোনোভাবে পরিবারের কোনো দায়িত্ব পালনে অবহেলা হচ্ছে না তো! শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার প্রতি অসন্তুষ্ট না তো?

চিত্র-২ : মিসেস সুরভী। আড়াই বছরের ছেলেকে বাসায় শাশুড়ির কাছে রেখে অফিস করেন। কিন্তু মনটা পড়ে থাকে বাড়িতে সন্তানের কাছে। দিন শেষে বাসায় ফিরে সন্তানের কাছে গেলে টের পান এতটুকু বাচ্চা কেমন অভিমান করে আছে মায়ের ওপর। অনেক চেষ্টা করেও কাছে আনা যায় না। আরো ছোটবেলায় অফিস থেকে এসে বুকের দুধ খাওয়াতে গেলেও মুখ ফিরিয়ে রাখত। এখন সে বড় হয়েছে। ছোট ছোট শব্দে কথা বলতে শিখেছে। মায়ের অনুপস্থিতি সে বেশ বুঝতে পারে। তাই তো মায়ের প্রতি নয়, তার যত আহ্লাদ আর আবদার সব বাবা আর দাদুর কাছে। সুরভী নিজেও টের পান সন্তানের সঙ্গে তার একটা অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বাবার বাড়ির লোকজন প্রায়ই বলে চাকরি ছেড়ে সন্তানের প্রতি মনোযোগী হতে। মাকে কাছে না পাওয়ার বিষয়টি যে ছেলেটির মনে চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলছে, বোনেরা তা বোঝানোর চেষ্টা করছেন বার বার। কিন্তু সুরভী কাউকে বোঝাতে পারছেন না যে সন্তানকে একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ দেওয়ার জন্যই তার এই কষ্ট। মাঝে মাঝে তাই দ্বিধায় পড়ে যান কোন পথে হাঁটবেন তিনি।

হীমি অথবা সুরভীর মতো এমন অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগেন বেশিরভাগ কর্মজীবী নারীই। দায়িত্ব-কর্তব্য আর নিরাপদ ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা এ দুটি বিষয়ের মধ্যে নিত্য চলে নারীর একাকী মানসিক যুদ্ধ। সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করা নারীটি যেমন  ভুগছেন এই মানসিক দ্বন্দ্বে, উচ্চপদে কাজ করা নারীটির বেলায়ও তা-ই। সাধারণভাবে নিজের জ্ঞান আর সামর্থ্যকে কাজে লাগিয়ে পুরুষ সঙ্গীটির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য কর্মক্ষেত্রে যোগ দেন নারী। কিন্তু একই সঙ্গে পরিবারের দায়িত্বে অবহেলা বা পরিবার-পরিজন থেকে দূরে সরে যাওয়ার ভয়ও চেপে ধরে তাকে। কখনো স্বেচ্ছায় আবার কখনো পরিবারের চাপে সরে আসতে হয় কর্মজীবন থেকে। অনেকেই আবার তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানিকে উপেক্ষা করেছেন পরিবারকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে। এ বিষয়ে কথা হয় বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত কয়েকজন নারীর সঙ্গে।

গার্মেন্ট শ্রমিক শাহীনা বেগম, স্বামী রিকশা চালায়। কিন্তু সারাদিনে যা আয়, তার সিংহভাগই জুয়া খেলে নষ্ট করে, নেশাগ্রস্ত স্বামী প্রায়ই বাড়িতে এসে তাকে মারধর করত। গার্মেন্টে কাজ করা নিয়ে নানা ধরনের অপবাদও দিত। হয় সংসার, নয়তো চাকরি- এমন সীমাও বেঁধে দিয়েছিল। একসময় সন্তানসম্ভবা শাহীনা দাম্পত্য জীবন বাঁচাতে আর অনাগত সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ছেড়ে দেন গার্মেন্টের কাজ। এখন অভাবের সংসারে কেমন আছেন শাহীনা, তার অনেকটাই আঁচ করা যায় তিন মাসের রুগ্ণ সন্তানটির দিকে তাকিয়ে।

কদিন বাদেই প্রমোশনের কথা ছিল রুনার। এরই মধ্যে জানতে পারলেন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। ব্যস, অনাগত সন্তানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে পরিবার থেকে চাপ এলো- এ অবস্থায় রোজ অফিস যাওয়া মা আর সন্তান দুজনের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ছাড়তে হবে চাকরি। নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে ফুটফুটে কন্যাসন্তানের মা হয়েছেন রুনা। এখন তিনি পুরোদস্তুর গৃহিণী। ‘ভেবেছিলাম মেয়ে একটু বড় হলে আবার কাজে ফিরে যাব। কিন্তু সন্তান দেখভালের কাজ আর ছোট বাচ্চাটাকে রেখে যাওয়ার কথা চিন্তাই করা যায় না।

কর্মজীবী নারীটিকে প্রতিনিয়ত অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বার বার নিজের ধৈর্যের সর্বোচ্চ পরীক্ষা দিয়ে বেছে নিতে হয় পরিবার আর ক্যারিয়ারের মধ্যে যে কোনো একটি। যারা সবদিক সামলে দুটিকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যান, মানসিকভাবে তারা কতখানি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যান, সেটি কেবল ওই সব নারীই জানেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনুভা জানান, পড়াশোনা করে একটি মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ালে সে কিন্তু তার পরিবারের জন্য একটি শক্ত খুঁটি হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট মেয়েদের ঘরকন্নার কাজে মনোযোগী দেখতেই বেশি পছন্দ করে। আর যদি মেয়েটি সবদিক সামলে কাজ করতেও পারে, তখন সবাই তার পেছনের নারী স্বাধীনতার নেতিবাচক দিক খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। আর এসব দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা নারীটির জন্য নিজের পেশাগত ক্ষেত্রে মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। নারীকে স্বাবলম্বী হতে হলে তাই সবার আগে প্রয়োজন তার পারিবারিক সাপোর্ট। পরিবার যখন কর্মজীবী নারীটির পাশে এসে দাঁড়াবে, তাকে মানসিক শক্তি জোগাবে, নির্ভরযোগ্য জায়গা হয়ে উঠবে- তখনই কেবল সে তার দ্বিধা কাটিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads