ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি

প্রতিনিধির পাঠানো ছবি

ফিচার

ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি

  • প্রকাশিত ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

রঙিন বেতের বুননে তৈরি শীতলপাটি আবহমান বাংলার লোকশিল্পের এক অনন্য ঐতিহ্য। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে ইউনেস্কোর ‘ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ (আইসিএইচ) কমিটির ১২তম অধিবেশনে বিশ্বের নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ২০১৭ (দি ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি) হিসেবে বাংলাদেশের এই শীতলপাটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

গ্রামবাংলার কারো ঘরে অতিথি এলে শীতলপাটি বিছিয়ে দেয়ার রেওয়াজ বহুকালের। তবে সম্প্রতি এ ঐতিহ্যে ছেদ পড়েছে। বাজারজাতকরণ, মূলধনের অভাব, ন্যায্যমূল্য ও মুর্তা বেতের অভাবে বিলুপ্তির পথে মৌলভীবাজারের ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজারের রাজনগর ও বড়লেখা উপজেলা শীতলপাটির জন্য বিখ্যাত। মুর্তা নামক একধরনের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের ছাল দিয়ে এই পাটি তৈরি করা হয়। এই গাছ এ অঞ্চলের প্রতিটি বাড়ির পেছনের ডোবার পাড় ও ঝোপজঙ্গলে পাওয়া যায়। দুটি উপজেলার হস্তশিল্পের কারিগররা কয়েক যুগ ধরে শীতলপাটি বুনছেন।

একটা সময় ছিল যখন এ অঞ্চলের ঘরে ঘরে শীতলপাটি বোনা হতো। অনেকের কাছে এ কুটিরশিল্প ছিল আয়ের বড় উৎস। মুর্তা বেত দিয়ে তৈরি শীতলপাটির কদর ছিল সব জায়গায়। একসময় সিলেট অঞ্চলের বিয়েতে সব সরঞ্জামের সঙ্গে একটি নকশি শীতলপাটি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। বর্তমানে এ রেওয়াজটি আর নেই। রঙিন মিহি বেতে তৈরি পাটিতে বিভিন্ন রঙের নামে পাটির মধ্যে বিখ্যাত ছিল সাদা পাটি, গুছি রঙা পাটি, আসমান তারা, চৌদ্দফুল কমলগুশ পাটি। এছাড়া হরেকরকম মসজিদ-হাঁস-মুরগি, পাখি, বক, হরিণের ছবিসহ বিভিন্ন শৈল্পিক নকশা তোলা হতো পাটিতে।

রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের ধুনিজুড়া, ফতেহপুর ইউনিয়নের বিলবাড়ি, তুলাপুর, আবদুল্লাপুর, জাহিদপুর মুন্সিবাজার ইউনিয়নের মেদিনীমহল, জুগিকোনা, মুনিয়ারপাড়; বড়লেখা উপজেলার দাসের বাজার ইউনিয়নের গোবিন্দপুর, পানি সাওয়া, বুলুয়াসহ বিভিন্ন গ্রামের হাজারও মানুষ এ পেশায় যুক্ত ছিলেন। কিন্তু উপযুক্ত দামের অভাব, বাজারজাতকরণের সমস্যা, মূলধনের ঘাটতি এবং মুর্তা বেতের অভাবে এখন আর আগের মতো পাটি বোনেন না শিল্পীরা। তাই বাধ্য হয়েই অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন তারা।

শীতলপাটির জন্য বিখ্যাত রাজনগর উপজেলার ধুনিজুড়ার শীতলপাটির কারিগর হরেন্দ্র দাশ বলেন, আমি ২০১৩ সালে সরকারিভাবে জাপান থেকে শীতলপাটি তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছি। একসময় গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস ছিল এই পাটির বুনন। বর্তমানে আমাদের গ্রামে হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার কোনোভাবে ধরে রেখেছে এ ঐতিহ্য। তিনি আরো বলেন, আমার পূর্বপুরুষরা এ কাজ করে গেছেন, তাই বাধ্য হয়ে আমাকেও এ কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু পরিশ্রম অনুযায়ী বাজারে উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় এ কাজে আগ্রহ হারাচ্ছেন কারিগররা। তাছাড়া আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে মূলধনও বিনিয়োগ করতে পারেন না তারা। এছাড়া ব্যাংক থেকে ঋণও পাওয়া যায় না। ফলে এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় ঝুঁকছেন অনেকেই।

ধুনিজুড়া গ্রামের মিনতী দাশ বলেন, বিয়ের পর শ্বশুর-শাশুড়িসহ পরিবারের প্রায় সবাই এ কাজ করতেন। তাদের কাছ থেকে আমিও শিখেছিলাম। কিন্তু দীর্ঘদিন কাজ না করায় এখন প্রায় ভুলতে বসেছি পাটির বুনন। একই গ্রামের অরুণ দাশ বলেন, ছেলেমেয়েরা এখন স্কুল-কলেজে পড়ছে। এটা শেখার প্রতি তাদেরও কোনো আগ্রহ নেই। শীতলপাটির জন্য এ গ্রামের সুনাম বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশের কাছেই অজানা। তাই এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

কারিগররা জানান, একটি সাধারণ পাটি বুনতে সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ দিন। পাটি বিক্রি করতে হয় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকায়। আর উন্নতমানের পাটি বুনতে সময় লাগে দেড় মাস। এটি বিক্রি করতে হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকায়।

শীতলপাটি শিল্প পরিষদের সভাপতি বেনু ভূষণ দাশ বলেন, বর্তমানে স্থানীয় বাজারে এ পাটির তেমন চাহিদা নেই; তবে ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, যশোর ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্ডার আসে। সে অনুযায়ী পাটি বুনে তাদের কাছে পাঠাই। মূলধন ও প্রশিক্ষণের অভাবে এ শিল্প বিকশিত হচ্ছে না। সরকারি উদ্যোগে ব্যাংক থেকে স্বল্পসুদে অথবা সুদবিহীন ঋণ দেওয়া হলে এই পাটি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

জেলার পাটির সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, শীতলপাটি শিল্পের বিকাশে যদি কেউ আমাদের কাছে এগিয়ে আসেন, তাহলে জেলা প্রশাসন ও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সহায়তা দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads