নজরুল ইসলাম নোবু
এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ২৪ বছরের পরাধীনতার শিকল ভেঙে অর্জিত হয় এক লাল সবুজের পতাকা। জন্ম হয় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের। তবে বিজয়ের পথ সহজ ছিল না। ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ দেশের স্বাধীনতা। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে এক বিস্ময়। এ দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি এখন বহির্বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই মিরাকলের মতো। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্গত। শুধু উন্নয়নশীলতার মধ্যেই থেমে নেই সফলতার গল্প। বিভিন্ন অর্জন ও সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে বিশ্ব দরবারে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে বেড়েছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। অতঃপর সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ইতোমধ্যে স্প্যান বসানোর কাজ সমাপ্ত হয়েছে। ফলে দৃশ্যমান হয়েছে পুরো পদ্মা সেতু। পূরণ হয়েছে স্বপ্ন। নির্মাণকাজ শেষ হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন এক নব মাত্রায় পৌঁছাবে। ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজও এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে। সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২২ সালে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এতে করে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধিত হবে। বর্তমানের অচল ঢাকা সচল ঢাকায় পরিণত হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের ফলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেড়েছে গতি। এছাড়া ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, ই-পাসপোর্ট, বাস ও রেলের অনলাইন টিকিট প্রভৃতি দেশের সার্বিক উন্নয়নকে সচল ও ত্বরান্বিত করছে। মাথাপিছু আয় ও প্রবৃদ্ধি বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে এবং এটি ক্রমবর্ধমান। বিনামূল্যে বই বিতরণ ও উপবৃত্তি প্রদানের ফলে বেড়েছে শিক্ষার হার। চিকিৎসা খাতের অগ্রগতির ফলে কমেছে শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার। জঙ্গিবাদ দমনেও বাংলাদেশের অনস্বীকার্য সফলতা ও সক্ষমতা প্রদর্শিত হয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি এবং গুজব দমাতে সাইবার ক্রাইম ইউনিট ইত্যাদি প্রশংসার দাবিদার। এভাবে তথাকথিত তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উত্তরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আজ স্বপ্ন দেখে উন্নত দেশে আসীন হওয়ার।
তবে প্রশ্ন হলো, আমরা নীতি নৈতিকতা ও মানবিকতার দিক দিয়ে কতটা উন্নয়ন সাধন করতে পেরেছি? বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আমরা আত্ম-জিজ্ঞাসা করতে পারব? হয়তো পারব না। কারণ আমাদের নীতি-নৈতিকতার জায়গাটুকু আজ বেজায় নড়বড়ে। কারণ আমাদের নীতি নৈতিকতা ও মানবিকতার চরম স্খলন ঘটেছে। ফলে বেড়েছে ধর্ষণ, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ঋণ খেলাপির মতো অসংখ্য নেতিবাচক ঘটনা।
উল্লিখিত সমস্ত অর্জন ও সফলতা ম্লান হয়ে যায় যখন শুনি পাঁচ বছরের শিশুটিকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ করা হয় এবং ধর্ষণ শেষে গলা টিপে হত্যা করা হয়। রাস্তার ধারে একা পেলে লুণ্ঠন করা হয় নারীদের সম্ভ্রম। আঁতকে উঠতে হয় যখন ভাবি নিজের বোনটি আজ নরপশুদের ভয়াল থেকে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবে তো?
যখন শুনি দেশ ও দশের কোটি কোটি টাকা পাচার করে কানাডায় বেগমপাড়া ও মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়ার প্রতিযোগিতা চলছে তখন সমস্ত অর্জন থমকে দাঁড়ায়। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)-এর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাদের তথ্য মতে, গত সাত বছরে এদেশ থেকে পাঁচ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। দেশীয় মুদ্রায় যা প্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। এই পরিমাণ টাকা দিয়ে আরো চারটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। জিএফআই-এর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বছরে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। সম্প্রতি কানাডার বেগমপাড়ার বেগমদের বিলাসবহুল জীবনযাপন দেখে সেখানকার কিছু দেশপ্রেমিক লোক তাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছে। অপরদিকে মালয়েশিয়ার সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী সেকেন্ড হোম প্রকল্পের বিনিয়োগে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
তারপর আমরা প্রত্যক্ষ করলাম দুর্নীতির মহাযজ্ঞ। যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বালিশ কাণ্ড, হাসপাতালের পর্দা কাণ্ড, ঢেউ টিন কাণ্ড এবং অতি সম্প্রতি নারিকেল গাছ ও কলাগাছের কাণ্ডও দেখলাম। এগুলো চুরি তো নয়, যেন পুকুরচুরি। সাগরচুরি বললেও অত্যুক্তি হবে না। যা যা বললাম তা কেবল দৃশ্যমান দুর্নীতি, লোকচক্ষুর অন্তরালে কি হচ্ছে তা কেবল ওপরে যে একজন সর্বদ্রষ্টা আছে; উনিই ভালো জানেন।
একেক জনের বাসার সিন্দুক থেকে কোটি কোটি টাকা পাওয়া গেল। কারো কারো বাসায় সোনাদানার খনিও উদ্ধার হলো। এদের কেউ তাদের অর্জিত সম্পদের বৈধ উৎস দেখাতে পারেনি। কেউ ক্যাসিনো ও জুয়াচুরি, কেউ চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি, কেউ মানি লন্ডারিং আবার কেউ নারী ব্যবসা ও মানব পাচার করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বর্তমানে আরেকটি ধান্ধাবাজির অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তা হলো ব্যাংক থেকে কোটি কোটি ঋণ নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া বা ঋণখেলাপি বনে যাওয়া। দেশের অনেকগুলো ব্যাংক আজ আর্থিক সংকটে ভুগছে।
১৬ ডিসেম্বর উনপঞ্চাশতম বিজয় দিবসে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশ। দুঃখজনক হলেও সত্যি, উনপঞ্চাশ পেরিয়ে অর্ধশতকের দোরগোড়ায় এসেও আমরা সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজালে আবদ্ধ। ধর্মান্ধতা ও উগ্রবাদী মনোভাব থেকে আজো আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। মেলেনি অর্থনৈতিক মুক্তি। আজো শ্রেণি বৈষম্যের বিষবাষ্পে হা-পিত্যেশ করতে হয়। ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান। ‘ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল দেশের তালিকায় ধনী জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি পাওয়ার হিসাবে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থান লাভ করেছে। ২০১৮ সালে সম্পদশালী বৃদ্ধির হার ও ২০২৩ সাল পর্যন্ত এর চলার গতি ধরে এ হিসাব করেছে ওয়েলথ-এক্স। সংস্থাটির ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে অতি ধনীর সংখ্যা ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। বৃদ্ধির এ হার বিশ্বে সর্বোচ্চ।
পরিতাপের বিষয় হলো, দুর্নীতি, টাকা পাচার, ঋণখেলাপির মতো সব অপকর্ম সম্পাদিত হচ্ছে সমাজের শিক্ষিত শ্রেণি কর্তৃক। এরা সকলেই শিক্ষিত; কিন্তু সুশিক্ষিত নয়। শিক্ষার আলো এদের আলোকিত করতে পারেনি। শিক্ষা এদের নীতি-নৈতিকতা, মানবিকতা এবং প্রকৃত দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। আমরা অবকাঠামোগত ও আর্থ-সামাজিকভাবে উন্নত হলেও নীতি-নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধের দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ছি। আমরা ভুলে যাই এ দেশের ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং ১০ শতাংশ মানুষ এখনো চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যাদের অনেকের দুবেলা দুমুঠো ভাতও জোটে না। একবারও কি মনের অন্তঃচক্ষু দিয়ে রাস্তার মোড়ে, বাসস্ট্যান্ডে বা রেলওয়ে স্টেশনে তাকিয়ে দেখেছি কতশত বিবস্ত্র-অর্ধনগ্ন মানুষ অনাহার-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে।
বাংলাদেশে উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু কতিপয় স্বার্থান্বেষী, অসাধু, লোভী, নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড সেই উন্নয়নের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাংলাদেশকে একটি সোনার দেশে পরিণত করতে এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে চাইলে আত্মশুদ্ধি ও আত্মোন্নয়নের বিকল্প নেই। সরকার শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে হয়তো গুটিকয়েককে শুদ্ধ করতে পারবে। কিন্তু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে পচন ধরেছে তা অভিযান চালিয়ে বন্ধ করা সম্ভব নয়। সমস্যাটা যেখানে ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত ব্যাপ্ত সেখানে শুধু আইন ও শুদ্ধি অভিযান দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়। তাই আসুন, আত্মশুদ্ধির শপথ নেই। শুরুটা পরিবার ও ব্যক্তি জীবন থেকেই করতে হবে। দেশটা আমার-আপনার, তাই আমাকে-আপনাকেই দায়িত্বটা নিতে হবে। প্রকৃত দেশপ্রেমের চর্চা করি। নইলে কখনোই উন্নয়নশীলতার গণ্ডি পেরিয়ে সমৃদ্ধ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং একটি উন্নত জাতিরাষ্ট্রে পদার্পণ করতে পারব না। বরং আমাদের স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে। আর অধরাই রয়ে যাবে বিজয়ের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
লেখক : অ্যালামনাস, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়





