সাইদ চৌধুরী
মানুষের মন থেকে দুর্নীতি কতটুকু দূর করা গেল? প্রশ্নের উত্তরে কেউ বলেন, দুর্নীতির শিকলে আটকে আপনি এসেছেন বলতে মন থেকে কতটুকু দুর্নীতি দূর করতে পারলাম এই বলতে! আবার কেউ নতি স্বীকার করে বলেন, আসলেই আমরা দুর্নীতি থেকে বের হতে পারিনি। কেউ কেউ দুর্নীতিবিরোধী কথা বললেই চাপিয়ে দেন দায়িত্বের বোঝা! সরাসরি বলেন, এ দায়িত্ব তার, ওর, অন্যের। কিন্তু প্রশ্ন আর উত্তরের সামজ্ঞস্য না থাকলে যেমন খাতায় ভালো নম্বর পাওয়া যায় না, তেমনি কথার মিল না হলে বাস্তবিক ক্ষেত্রে কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না।
দুর্নীতি রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের জেঁকে বসেছে এটা যেমন সত্য, তেমনি দুর্নীতিকে আমরা প্রশ্রয় দিচ্ছি বা দিতে বাধ্য হচ্ছি সেটিও সত্য। করোনাকালীন সময়ে মানুষের মনোজাগতিক অনেক পরিবর্তন হলেও নিজেকে বদলানোর ক্ষেত্রে কতটুকু পরিবর্তন হলো- এ প্রশ্নের কি কোনো জবাব আছে?
এক হলো ভয় পেয়ে আমি খারাপ কাজ করি না, আরেক হলো আমি খারাপ কাজ করি না আমাদের মনের পবিত্রতার কারণেই। দুইয়ের মধ্যে বড় ফারাক বোঝা যায় দুর্নীতিবাজ কোনো মানুষের কথা শুনলেই। কোনো কাজের জন্য কারো কাছে গেলে যদি শুনে আসেন এই কাজের জন্য আপনাকে ভাউচারবিহীন এতগুলো টাকা গুনতে হবে তখন আপনার মনের থেকেই প্রশ্ন হবে, তাহলে আমি কীভাবে এ টাকাটা দেব বা দেব কেন? প্রশাসনিক কাজে দুর্নীতি কমানোর জন্য সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু পদক্ষেপগুলো বার বারই আটকে যায় দুর্নীতিবাজদের জন্যই। ঘুষবিহীন কাজ করতে ভোগান্তির বিষয়টি সরকার পর্যন্ত পৌঁছে না। গ্রামের সাধারণ কৃষক যদি কোনো ব্যাংকে ঋণ নিতে যায় তখন সে যদি সরাসরি কথা বলতে না পারে সেক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ ঘুষ নিয়ে নেয়। চাকরির প্রলভনে এখনো মানুষ অনেক টাকা অবৈধভাবেই ব্যয় করে। সব ছাপিয়ে গেছে সরকারি বিভিন্ন কাজে ক্রয়ের দুর্নীতিগুলো। কিছুদিন আগেও দেখা যেত প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির হার বেশি। কিন্তু বর্তমানে তা পুরো চেপেছে ক্রয় বাণিজ্যে। আশ্চর্যজনক সত্য হলো, একেবারে কম টাকার দ্রব্যও ভাউচারে হয়ে যায় লক্ষ কোটি টাকার জিনিস। স্বাস্থ্য খাতও এই দুর্নীতি থেকে রেহায় পায়নি। নতুনভাবে শুরু হয়েছে বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। যারা দুর্নীতি করছে এবং সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এই দুয়ের মধ্যে যে বিষয়টি দূরত্ব সৃষ্টি করছে তা হলো দায়বদ্ধতার জায়গায় কাউকে রিপোর্ট করতে হয় না। মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রশাসনিক সর্বনিম্ন স্তরের একজন সরকারি চাকরিজীবী কতটুকু দায়বদ্ধ সে যদি না জানে বা না মানে তবে দুর্নীতি রোধ সত্যিই কঠিন একটি কাজ।
দুর্নীতি বন্ধে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বার বার দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব সৃষ্টির বিষয়ে আমরা মনোযোগ দিয়েছি। কিন্তু তাদের মননে কি আমরা সত্যিই পারছি দুর্নীতি না করার শপথটি ঢোকাতে! অনেক বাবা পেনশনের টাকা পর্যন্ত রেখে দেন তিনি তার টাকা দিয়ে চাকরি নিয়ে দেবেন সন্তানকে। সন্তানের মনে তখন প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, কেন বাবা চাকরি নেওয়ার জন্য টাকা রেখে দিচ্ছেন? নীতির বাইরে যা করা হয় তাই তো দুর্নীতি। এখন যখন কোনো এলাকায় কোনো মানুষ বন দখল করে নেয় সেও তো নীতির বাইরে কাজ করল। এই দুর্নীতিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সে আরো অন্য মানুষকে প্রভাবিত করে দুর্নীতিতে যুক্ত হতে। এভাবেই সবার মধ্যে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। এখন সরকারের একার পক্ষে দুর্নীতি বন্ধ না করা গেলেও সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে খুব দৃঢ়ভাবেই। কারণ আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে।
অর্থের গতিশীলতা একমুখী হয়ে যাচ্ছে। কিছু মানুষের কাছে অনেক টাকা হয়ে গেছে আর কিছু মানুষ কোনোরকমে খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে সামাজিকভাবেই একটা অসাজ্ঞস্য দেখা দেবে। অধিকারের প্রশ্নে নাগরিক অধিকারে হেরফেরে একটা সময় সার্বিক সামাজিক কাঠামোর মধ্যেই নিয়ম না মানার চর্চা শুরু হতে থাকবে। অনেকটা এখনই তা দৃশ্যমান। যাদের হাতে টাকা বেশি চলে যাচ্ছে তারা বেশির ভাগ সময় আইনকেও অবজ্ঞা করে চলার পাঁয়তারা করছে। সরকারের এখন উচিত হবে দুর্নীতি সমূলে ধ্বংস করার জন্য যে-কোনো একটি একটি খাতকে দুর্নীতিমুক্ত ঘোষণা করা। দুদক যেভাবে কাজ করছে তাকে আরো জনবল দিয়ে শক্তিশালী করা। যে যে জায়গায় দুর্নীতি হয় সেখানে অনলাইন মনিটরিং সিস্টেম চালনার ব্যাপারেও ভাবা যেতে পারে। শুধু তাই নয়, যারা দুর্নীতিবাজ রয়েছে তাদের শাস্তির আওতায় আনা খুব জরুরি। দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে তাকে বহিষ্কার করে তদন্ত করা প্রয়োজন। নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে প্রমাণ করার আগ পর্যন্ত তার প্রার্থিতা স্থগিতও রাখা প্রয়োজন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে অন্য যে-কোনো উপায়ে দুর্নীতি বন্ধ করতে চাওয়ায় কোনো সুফল আসবে না।
সামনের দিনগুলোতে দুর্নীতি রুখে দেওয়ায় সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হোক আর সে ক্ষেত্রে শিক্ষাকে সবার আগে দুর্নীতি মুক্ত করে সামনে এগিয়ে যাওয়াই হতে পারে বড় সফলতা।
লেখক : সদস্য, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, শ্রীপুর, গাজীপুর





