আসুন, পথশিশুদের পাশে দাঁড়াই

পথশিশু

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

আসুন, পথশিশুদের পাশে দাঁড়াই

  • নাজমুল হোসেন
  • প্রকাশিত ১১ মার্চ, ২০১৯

পথশিশু হলো সেই সব শিশু যারা দারিদ্র্য, গৃহহীনতা বা উভয় কারণে শহর, নগর বা গ্রামের রাস্তায় বসবাস করছে। আমাদের দেশে এই পথশিশুর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মূলে রয়েছে অজ্ঞতা, দরিদ্রতা, অশিক্ষা ও সচেতনতার অভাব। বলতে হয়, আমাদের দেশে একশ্রেণির অশিক্ষিত ও দরিদ্র মানুষ রয়েছে, যারা অপরিকল্পিতভাবে শিশুর জন্ম দিয়ে থাকে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর তাদের পরিত্যাগ করে, ভরণ-পোষণ দেয় না। এসব পিতা-মাতা আবার অন্য কাউকে বিয়ে করে নতুন করে সংসার শুরু করেন। এভাবেই ধাপে ধাপে এরা সন্তান জন্ম দিয়ে থাকেন আর এভাবেই বৃদ্ধি পেতে থাকে অবহেলিত পথশিশুর সংখ্যা। এসব পিতা-মাতা সন্তানদের মারধর করেন রোজগার করার জন্য। তখন থেকেই শুরু হয় তাদের অবহেলিত কষ্টের জীবন।

আদর, স্নেহ, ভালোবাসা জড়িয়ে থাকা কথাটির নাম শিশু। সেই শিশুরাই আবার অনেক সময় টোকাই বা পিচ্চি নামে পরিচিত হয়। খালি গায়ে, খালি পায়ে কিংবা ছেঁড়া জামাকাপড় পরে রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড ও শহরের অলিগলি এলাকাতেই এদের বিচরণ। আবার রাতের বেলায়ও যেখানে-সেখানে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। অর্থাৎ এদের জীবনটা হচ্ছে— যেখানে রাত, সেখানেই কাত-এর মতো। কোনো ট্রেন ছাড়ার আগে ছোট-বড় ব্যাগ নিয়ে ছুটতে দেখা যায় তাদের। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা বোতল, পলিথিন, কাগজসহ মানুষের ব্যবহূত ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র কুড়ানো ও ভিক্ষার মাধ্যমেই চলে তাদের দৈনন্দিন জীবন। তা ছাড়া বাসস্ট্যান্ডে অনেক পথশিশুকে বাসের কন্ডাক্টরের সাথে যাত্রী হাঁকতে দেখা যায়। সব্যসাচী মানুষের ধিক্কার, গালাগাল, চড়-থাপ্পড়সহ এমনকি শারীরিক নির্যাতনও সহ্য করতে হয় তাদের প্রতিনিয়ত। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই এরা অনাদর, অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হয়েছে ধাপে ধাপে। রাস্তার পাশে জেগে ওঠা আবর্জনার স্তূপ, বাস, টার্মিনাল-রেলস্টেশন এখানে-সেখানে নোংরা অপরিচ্ছন্ন স্থানটুকুই আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেয় ওরা। ওরা যেন সমাজের সর্বোচ্চ অবহেলিত মানুষ। কিন্তু এদের কেন এই অবহেলিত জীবন আর এর দায়ভারই বা কার? ওদের নিয়ে ভাবনার সময় হয় না কারো। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়সহ সব পরিস্থিতিতেও ওরা কারো সহানুভূতিটুকুও পায় না কখনো। এমনকি ঈদ বা বিশেষ কোনো দিনেও সামান্য ভালো খাবার, নতুন জামা-কাপড় বা এক চিলতে আনন্দ তাদের জীবনে আসে না।

জাতিসংঘের শিশু সনদ ও আমাদের দেশের আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু বলা হয়েছে। বিভিন্ন তথ্যমতে, বাংলাদেশে জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ ভাগ শিশু, যার ৪০ ভাগ শিশু বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে। দেশে এখন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭৯ লাখেরও বেশি। তাদের কর্মস্থল হচ্ছে বাসস্ট্যান্ড, ফেরিঘাট বা রেলস্টেশন। গত দশক থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিস্ময়কর উন্নতি সাধিত হয়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, রিজার্ভ ব্যাংক ফুলে উঠেছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি নামক পাখিও তরতর করে বেড়ে চলেছে। কিন্তু এতসব অর্জন কোনো কাজে আসেনি সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের।

যে শিশুরা শৈশব আর কৈশোরের অবাধ স্বাধীন জীবনকে বিসর্জন দিয়ে দু-মুঠো ভাতের জন্য পথে পথে ঘুরছে, স্বল্প মজুরিতে অমানসিক ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম দিচ্ছে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের কারণে অল্প বয়সেই শরীরে নানা রকম রোগের জন্ম দিচ্ছে— তাদের অনেকের আবার অকালে প্রাণও ঝরছে। তাদের কাছে রিজার্ভ ব্যাংক আর প্রবৃদ্ধি ফাকা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ধারা ৩৪ ও ৩৫ অনুযায়ী ১৪ বছরের কোনো শিশুকে কাজে নিয়োগ করা যাবে না। সেখানে আরও বলা হয়েছে, শিশুর পিতা-মাতা কিংবা অভিভাবক শিশুকে দিয়ে কাজ করানোর জন্য কারো সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে পারবে না। কিন্তু এসব নীতিকে পাস কাটিয়েই শিশুদের নিযুক্ত করা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে শিশুদের অভিভাবকরাই শিশুদের পড়ালেখা বাদ দিয়ে কাজ করতে পাঠাচ্ছেন। যে বয়সে এসব শিশুর যাওয়ার কথা ছিল স্কুলে কিংবা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে খেলার মাঠে, উৎসবে- সেই বয়সে তাদের নামতে হচ্ছে জীবনযুদ্ধে।

আমরা সবাই জানি, অভাবের তাড়নায় আর পেটের দায়ে এরা সবাই জড়িয়ে পড়ছে অপরাধ জগতে, মাদকের জগতে। বাংলাদেশে যত ছিনতাইয়ের ঘটনা বা রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে, তার মূলে এদের রয়েছে প্রত্যক্ষ ভূমিকা। গাড়িতে আগুন দেওয়া, বোমা মারা বা ভাঙচুর করার মতো কাজগুলো একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতারা এদের দিয়েই করিয়ে থাকেন। মাত্র চারশ বা পাঁচশ টাকার জন্য এরা মানুষ খুন করতে পারে! শৈশব থেকেই অন্ধকার ও অনিশ্চিত একটা পৃথিবীর দিকে তাদের যাত্রা শুরু হয় আর সেই অবহেলিত অন্ধকার জীবন তথা এমন দুর্বলতার সুযোগই নেয় কিছু নষ্ট-ভ্রষ্ট রাজনৈতিক নেতা।

এত বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থানসহ নিরাপদ একটা শৈশব বঞ্চিত করে কি আলোকিত একটা বাংলাদেশ হবে? এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে কোনো দল বা সরকারের কোনোকালে এতটুকু মাথাব্যথা দেখিনি। কানাডাসহ অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রে পিতা-মাতার চেয়ে সন্তানদের দেখভাল করার দায়িত্ব বেশি সরকারের। সেখানে সন্তান জন্মের পরই তার ভরণ-পোষণ বা লালন-পালনে কোনো অবহেলা করা হচ্ছে কি-না, সরকারের কাছে তার জবাবদিহি পিতা-মাতাকে করতে হয়। আর আমাদের দেশে দেখা যায় তার উল্টো চিত্র। যে মৌলিক অধিকারগুলো পাওয়ার কথা, সেগুলোর ৯০ ভাগ থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে তারা। অথচ একটু পরিকল্পনামাফিক আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে কয়েক বছরের মধ্যেই পথশিশুর সংখ্যা শূন্যের কোটায় আনা সম্ভব। শিক্ষাবঞ্চিত, সমাজ-সভ্যতার তিমিরে নিমজ্জিত ছিন্নমূল টোকাই-পিচ্চিদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে ওদের মেধা ও শ্রমের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটিয়ে দেশের সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। ভিক্ষা নয়, দেশের উৎপাদনের বড় একটি অংশের জোগান দেওয়া যেতে পারে তাদের মাধ্যমে।

এ জন্য প্রথমেই প্রতিটি জেলায় না হোক, অন্তত বিভাগীয় শহরগুলোতে সরকারি ও বিত্তবানদের অর্থায়নে মোটামুটি মৌলিক অধিকারগুলো অর্থাৎ খাদ্য, শিক্ষা, বস্ত্র, চিকিৎসা ইত্যাদি নিশ্চিত করে একটি করে পথশিশু কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে মেগা সিটিগুলোতে (ঢাকা ও চট্টগ্রাম) একের অধিক এ ধরনের কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। পথশিশুদের আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তুললে ঠিকানাহীন নিরাশ্রয় এসব শিশু মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠবে। উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়ার ক্ষেত্রে এরাও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। দেশে নতুন করে আর কোনো আলোচিত টোকাই সাগর বা পিচ্চি হান্নানের মতো সন্ত্রাসী তৈরি হবে না।

 

লেখক : প্রকৌশলী

nazmulhussen@yahoo.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads