আপডেট : ০২ September ২০২৩
আকরামুজ্জামান আরিফ, কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়ায় বিষধর সাপের উপদ্রব দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতে প্রায় দিনই সাপের কামড়ে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে এন্টিভেনম না থাকার কারণে সাপে কাটা রোগীর একমাত্র ভরসা কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল। তবে এক মাসের বেশি সময় ধরে সেই হাসপাতলেও কোনো অ্যান্টিভেনম (প্রতিষেধক) নেই। গত ২৩ আগস্ট কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের ইব্রাহিমের স্ত্রী আয়েশা খাতুন (২৫) ও তার ৭ মাস বয়সী কন্যা নুসরাত জাহানকে বিষাক্ত কালাচ সাপ কামড় দিলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিশুটির মৃত্যু হয়। আয়েশা খাতুনকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে। সেখানেও প্রতিষেধক টিকা (অ্যান্টিভেনম) না থাকায় কিছুক্ষণ পর আয়েশার মৃত্যু হয়। নিহতের স্বজনরা জানান, হাসপাতালে প্রতিষেধক টিকা (অ্যান্টিভেনম) না থাকায় চিকিৎসকের পরামর্শে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে বাইরের ফার্মেসী থেকে কিনে আনলেও সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে কিছুক্ষণ পর আয়েশার মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর থেকে আতঙ্কিত স্থানীয়রা। তারা বলছেন, বর্তমানে বর্ষা মৌসুমে সাপের উপদ্রব বাড়লেও হাসপাতালে প্রতিষেধক টিকা না থাকায় তৈরি হয়েছে ঝুঁকি। আবার সাপে কামড়ের পর মানুষের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণেও হচ্ছে প্রাণহানি। রেজাউল ইসলাম নামের একজন বলেন, ”৬টি উপজেলা নিয়ে কুষ্টিয়া জেলা। এমন অনেক এলাকা আছে যেখান থেকে ২ ঘণ্টায়ও কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এছাড়া বাইরে থেকে অ্যান্টিভেনম কেনা বেশ ব্যয়বহুল। যা বেশিরভাগ মানুষের সামর্থ্যরে বাইরে। সেক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ে প্রতিষেধক টিকার ব্যবস্থা রাখার বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিৎ।” খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মা-মেয়ে ছাড়াও আগষ্ট মাসে সাপের কামড়ে মারা যান জেলার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের মাঝগ্রামের নববধূ মিতু (২০) ও দৌলতপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর সীমান্ত এলাকার বুলবুল বিশ্বাস(৫৫)। গত ১৮ আগষ্ট একদিনে খোকসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঁচ নারী-পুরুষ সাপের কামড়ে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের মধ্যে গোপগ্রাম ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামের রোহান (১৮) ও শ্রাবণী(২১)কে ফরিদপুর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া সাপের কামড়ে আহত রুহুল আমিন (৫০),ঝর্ণা (৩০)ও সালমা(৩৫) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নেয়। সূত্র জানায়, গত জুন মাস থেকে জেনারেল হাসপাতালে অ্যান্টিভেনমের সরবরাহ নেই। বিষাক্ত রাসেল ভাইপারসহ গোখরা সাপের কামড়ে আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে বেশি আসছে। জেলার কোন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই থাকেনা সাপে কাটার প্রতিষেধক টিকা (অ্যান্টিভেনম)। উপজেলা থেকে সাপে কাটা রোগীদের কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেও জুন মাসের পর থেকে প্রতিষেধক সংকট রয়েছে। তবে হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে প্রতি বছর চাহিদার বেশি প্রতিষেধক টিকা আসলেও মেয়াদ স্বল্পতার কারণে সেগুলোর প্রয়োগেও থেকে যায় নানা জটিলতা। তাছাড়া চাহিদার বাড়তি ডোজ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সরবরাহ করা হয়। কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডাঃ এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ”বিষধর সাপের কামড়ের প্রতিষেধক টিকার চাহিদা কুষ্টিয়ায় ২০০ ডোজ। চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। আগামী সপ্তাহে প্রতিষেধক টিকা আসতে পারে বলে তিনি জানান।” কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের সামনের এক ফার্মেসী মালিকের সাথে কথা হলে তিনি জানান, বাংলাদেশের একটি সুনামধন্য ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা সাপে কাটা প্রতিষেধক টিকা (অ্যান্টিভেনম) তিনি বিক্রি করেন। প্রতি ভাওয়েলের দাম ১ হাজার ৪০০ টাকা। একজন সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা ভেদে সর্বোচ্চ ২৫ ভাওয়েল পর্যন্ত অ্যান্টিভেনম প্রয়োজন হতে পারে। যা বেশ ব্যয়বহুল। গবেষকরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে সকাল ও সন্ধ্যায় সাপে বেশি ছোবল দেয়। বন্যা প্লাবণ এলাকায় সাপে বেশি ছোবল দেয়। শীতকালে গোখরা সাপের দংশনের ঘটনা ঘটে। বর্ষাকালে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাপে কাটা রোগী হাসপাতালে আনার পথে মৃত্যুু ঘটে। বাংলাদেশ জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এস আই সোহেল বলেন, ”আমাদের এ অঞ্চলে চার ধরনের বিষধর সাপের বিস্তার রয়েছে। বেশিরভাগ সাপে কাটা রোগী মরা যায় পদ্ম গোখরা, খৈয়া গোখরা,কালাচ নতুবা রাসেলস ভাইপারের কামড়ে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটা প্রচলিত ভুল ধারণা আছে সাপে কাটলেই মানুষের মৃত্যু হবে। কিন্তু ৮০ শতাংশ সাপের কামড়ের ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিষ থাকে না। সাপের কামড়ের পর প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত যত দ্রæত সম্ভব সাপে কামড়ানোর ওষুধ বা অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা। তাহলেই মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।” কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা(আরএমও) তাপস কুমার সরকার বলেন, ”হাসপাতালে থাকা অ্যান্টিভেনম বেশ কিছুদিন আগেই ফুরিয়ে গেছে। চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে, এখনও সরবরাহ পায়নি। মুলত ভারত থেকে আমাদের দেশে অ্যান্টিভেনম আসে। সম্প্রতি সে দেশেও অ্যান্টিভেনমের চাহিদা বেড়ে গেছে। তাই বিলম্ব হচ্ছে।” অ্যান্টিভেনম সংকটে সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া ব্যাহত হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ”সাপে কাটা রোগীদের প্রাথমিক যে সকল চিকিৎসা রয়েছে তা দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, রোগীদের একদমই আতঙ্কিত হতে দেয়া যাবে না। কারণ সাপের কামড়ে যত মানুষ মারা যায় তার চাইতে বেশি মানুষ মারা যান কামড় খেয়ে আতঙ্কিত হওয়ার ফলে। সাপে কামড়ানো জায়গা তৎক্ষণাৎ পরিষ্কার ব্যান্ডেজ বা সুতির কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে, যাতে ধুলোবালি না লাগে। কামড় দেখে বুঝতে হবে যে এটি বিষধর সাপে কামড়েছে নাকি বিষহীন সাপে কামড়েছে। তারপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। সাপে কাটলে বাঁচার পথ একটাই। এক সেকেন্ড সময় নষ্ট না করে সোজা রোগীকে নিয়ে সরকারি হাসপাতালে যাওয়া।”
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১