আপডেট : ২৯ June ২০২২
জ্বালানি তেল নিয়ে উভয় সঙ্কটে পড়েছে সরকার। একদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে অব্যাহত দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে প্রতিদিন শতকোটি টাকা লোকসান গুণছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা- বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। অন্যদিকে, জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ব বাজারে সঙ্গে সমন্বয় করলে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়বে অস্বাভাবিকহারে। এতে চরম বিপাকে পড়বে সাধারণ মানুষ। তাই জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এখন বৈশ্বিক বাস্তবতা হলেও দেশের বাজারে দাম সমন্বয় করা হলে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তারা সরকারকে বিকল্প চিন্তার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে সরকার সংশ্লিষ্টরা আভাস দিয়েছেন, আগামি মাসেই বাড়ানো হতে পারে জ্বালানি তেলের দাম। এর আগে নির্ধারণ করা হবে পরিবহন ভাড়া। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদিনই বাড়ছে জ্বালানি তেলের দাম। ফলে দৈনিক শতকোটি টাকারও বেশি লোকসান দিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিপিসি। এ অবস্থা চলতে থাকলে তিন মাস পর বিপিসি আমদানির সক্ষমতা হারাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এমন প্রেক্ষিতে তেলের সরবরাহ ঠিক রাখতে দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনতে চাচ্ছে সরকার। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও সবুজ সংকেত দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে দাম বাড়ালে মানুষের জীবনযাত্রাসহ বিভিন্ন খাতে এর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে গভীরভাবে তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে গণপরিবহনে যে লাগামহীন নৈরাজ্য তৈরি হয়- কীভাবে তা নিরসন করা যায়, তা নিয়ে চলছে চুলচেড়া বিশ্লেষণ। সংশ্লিষ্টরা সূত্রে জানা গেছে, এবার প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ২০ থেকে ৩০ টাকার মতো বাড়তে পারে। তবে তেলের দাম বাড়ানোর আগেই এবার গণপরিবহন ও লঞ্চ ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে চায় সরকার। লিটারে ডিজেলের দাম ২০ কিংবা ৩০ টাকা বাড়ানো হলে কিলোমিটার প্রতি কত টাকা পরিবহন ভাড়া বাড়বে সেই হিসাব চলছে। এ বিষয়ে পরিবহন মালিক ও তেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গত সোমবার বিদ্যুৎ ভবনে বৈঠকও করেছে জ্বালানি বিভাগ। বৈঠকে পরিবহন মালিক সমিতিসহ জ্বালানি তেল ব্যবহারের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন শ্রেণির নেতাদের উপস্থিতিতে নিজেদের অবস্থা তুলে ধরে বিপিসি। বিপিসি সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছে, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম যে হারে বাড়ছে তাতে প্রতিদিন একশ কোটি টাকার ওপরে সংস্থাটি লোকসান করছে। দাম যে আরো কত বাড়বে সেটাও অনুমান করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায়ও জ্বালানি তেল সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে বিপিসি। তবে মূল্য সমন্বয় না করলে তা অব্যাহত রাখা কঠিন হবে। বিপিসি বলছে- আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি ব্যারেল ডিজেল যদি ৮৪ দশমিক ৬৪ মার্কিন ডলারে আমদানি করা যায়, তবে বিপিসি ব্রেক ইভেন পয়েন্টে থাকে। একই সঙ্গে অকটেন যদি প্রতি ব্যারেল ৯০ দশমিক ৮৯ টাকায় আমদানি করা যায় তখনো ব্রেক ইভেন পয়েন্টে থাকে; কিন্তু গত ডিসেম্বর থেকে বিশ্ববাজারে অব্যাহতভাবে ডিজেল ও অকটেনের দাম বাড়ছে। সর্বশেষ চলতি মাসের ১ থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত ডিজেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ১৭১ দশমিক ৮৬ মার্কিন ডলার এবং অকটেনে দাম ব্যারেলপ্রতি ১৪৮ দশমিক ৭৩ মার্কিন ডলারে বিক্রি হচ্ছে। একই সঙ্গে ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামও বেড়ে ব্যারেল প্রতি দাঁড়িয়েছে ১১৫ মার্কিন ডলার। বিপিসিকে সেই বাড়তি দাম দিয়েই তেল আমদানি ও সরবরাহ করতে হচ্ছে। আর দেশের বাজারে প্রতিলিটার ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়, এক্ষেত্রে বিপিসিকে লোকসান দিতে হচ্ছে ৫৫ টাকা ১৬ পয়সা। অকটেন বিক্রি হচ্ছে ৮৯ টাকা লিটার, লোকসান গুনতে হচ্ছে ৩৬ টাকা ৬১ পয়সা। এ ছাড়া দেশের ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) উৎপাদিত পেট্রোলেও ১০ টাকা ৮৭ পয়সা লোকসান দিচ্ছে বিপিসি। সেই পেট্রোল প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ৮৬ টাকায়। আমদানি না করলেও জ্বালানিটির উৎপাদনখরচ ৯৬ টাকা ৮৭ পয়সা। এখন প্রতিদিন ডিজেল বিক্রিতে সংস্থাটির লোকসান হচ্ছে ৯১ দশমিক ৫৯ কোটি টাকা, অকটেনে ৬ দশমিক ৫১ কোটি টাকা, পেট্রোলে ২ কোটি ৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন ধরনের জ্বালানি তেল বিক্রি করে সংস্থাটি প্রতিদিন ১০০ কোটি ১৮ লাখ টাকা লোকসান দিচ্ছে। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের আমদানি ও সরবরাহ অব্যাহত রাখতে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি বা সমন্বয়ের কোনো বিকল্প দেখছে না জ্বালানি বিভাগ। এদিক জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হলে পরিবহন ভাড়া কত হবে তা নিয়েও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক হচ্ছে। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রতি লিটারে ৩০ টাকা তেলের দাম বাড়লে কিলোমিটারপ্রতি বাসের সম্ভাব্য ভাড়া হবে ২ টাকা ৩৯ পয়সা এবং দূর পাল্লার ক্ষেত্রে ২ টাকা ০৫৮ পয়সা। আর ২০ টাকা বাড়ানো হলে কিলোমিটারপ্রতি সম্ভাব্য ভাড়া হতে পারে ২ টাকা ৩১ পয়সা, দূরপাল্লার ক্ষেত্রে ১ টাকা ৯৭ পয়সা। লঞ্চ ভাড়ার ক্ষেত্রে দেখানো হয়েছে- জ্বালানি তেলের দাম যদি লিটারপ্রতি ১০ টাকা বাড়ে তবে আগের ভাড়ার সঙ্গে যাত্রীপ্রতি ১২ পয়সা, যদি ২০ টাকা বাড়ে তবে যাত্রীপ্রতি ২৪ পয়সা, যদি ৩০ টাকা বাড়ে তবে যাত্রীপ্রতি ৩৬ পয়সা বাড়তে পারে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লা বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে পরিবহন ভাড়া কী হতে পারে- এ বিষয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, আমি সেখানে ছিলাম। তবে পরিবহন ভাড়া নির্ধারণ করবে বিআরটিএ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হোসেন আহমেদ মজুমদার বলেন, যখন দেশের বাজারে ডিজেলের দাম ৬৫ টাকা ছিল তখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম তলানিতে ছিল। এখন বেশি হওয়ায় বিপিসি লোকসানের হিসাব দিচ্ছে। তখন কত লাভ করেছিল সেই হিসাবও দেওয়া দরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেলের বাজারে অস্থিরতা চলছে। যুদ্ধ চলতে থাকলে জ্বালানির বাজার আরো খারাপের দিকে যেতে পারে। এতে আমদানিকারক দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের বাজারে দাম সমন্বয় করা হলে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কারণ এরই মধ্যে এক দফা ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ানোয় নিত্যপণ্যের বাজারে তার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। জনজীবনে এখনো সেই অস্থিরতার রেশ কাটেনি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এখন বৈশ্বিক বাস্তবতা। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছে। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই এর পেছনে দায়ী। তবে এ কারণে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা অযৌক্তিক। কারণ কিছুদিন আগেই লিটারপ্রতি ১৫ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। এখন আরেক দফা বাড়ালে তা জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এর চেয়ে বরং সরকার নিত্যপণ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাড় দিতে পারে। তাতে বাজার স্বাভাবিক রাখা যাবে। বিপিসি সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের অন্তত ১৭ হাজার টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। বাৎসরিক চাহিদা ৬৮ লাখ টন। যার পুরোটাই আমদানিনির্ভর। এর মধ্যে ৭৩ শতাংশ ডিজেল। অকটেন ৫ শতাংশ, পেট্রোল ৬ শতাংশ, কেরোসিনসহ অন্যান্য জ্বালানি তেল ব্যবহার হয় ১৯ শতাংশ। যোগাযোগ ও পরিবহন খাতে জ্বালানি তেলের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি, যা প্রায় ৬৫ শতাংশ। এর বেশির ভাগই ডিজেল। কৃষিতে ডিজেল ব্যবহার হয় ১৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ পেট্রোলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েমনের সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হক বলেন, তেলের দাম বৃদ্ধির আগে মানুষকে বিষয়টি জানাতে হবে। মানুষের মাইন্ড সেট ঠিক করতে হবে। তা না হলে হঠাৎ করে তেলের দাম বৃদ্ধি মানুষ মেনে নিতে পারবে না।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১