বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০৩ December ২০২১

জেনোমিক গবেষণার প্রধান প্রতিবন্ধকতা অর্থ সংকট


বিশ্বে প্রথমবারের মতো রুই, কালবাউশ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য এবং দেশে প্রথমবারের মতো কাতল ও মৃগেল মাছের জীবন রহস্য উন্মোচন করেছেন বাংলাদেশের একদল গবেষক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর ড. মনজুরুল কিবরীয়া এবং চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ এম এ এম জুনায়েদ সিদ্দিকী এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন। ড. জুনায়েদ সিদ্দিকীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন - অরণ্য সৌরভ


গবেষণার উদ্যোগের পেছনের গল্প
হালদা নদী কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশের অদ্বিতীয় নদী। দীর্ঘদিন যাবত আমরা হালদা নদী এবং এর বিভিন্ন প্রজাতি সংরক্ষনের গবেষণায় মলিকিউলার জীবপ্রযুক্তি প্রয়োগের জন্যে ভাবছিলাম। ২০১৮ সালে, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত জেনোমিকস রিসার্চ গ্রুপের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো আমরা ব্ল্যাক বেঙ্গল প্রজাতির দেশীয় কালো ছাগলের জিনোম বিন্যাস উন্মোচন করতে সক্ষম হই। তারই ধারাবাহিকতায় অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া স্যারের সহযোগীতায় আমরা হালদার বিভিন্ন প্রজাতির জিনোম বিন্যাস উতঘাটনের জন্যে ব্যপৃত হই।

গবেষণাটি শুরুর গল্প
গবেষণাটি যেহেতু অত্যন্ত ব্যায়বহুল, প্রাথমিকভাবে আমরা বিভিন্ন গবেষণায় অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করি। এরই ধারাবাহিকতায় আইডিএফের (ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন) মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে অংশগ্রহণ করে পিকেএসএফ (পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন) এর গবেষণা অনুদানের জন্য মনোনিত হই। অনুদান পাওয়ার পর প্রথমেই ছিল নমুনা সংগ্রহের কাজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরীর ফ্রিজারে সংরক্ষিত ডলফিনসহ চারটি প্রজাতির মেজর কার্প মাছের লিভার, টিস্যু এবং রক্ত থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছি। সেই নমুনা থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে আমরা আমাদের সিকোয়েন্সের ডাটা অত্যাধুনিক এনজিএস (ঘএঝ) প্রযুক্তির মাধ্যমে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সার্ভার কম্পিউটারে বিশ্লেষণ করি। বিদেশ থেকে আসা বিপুল পরিমাণ জেনোমিক তথ্য সমূহকে দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সার্ভারে বিশ্লেষণ করতে হয়েছে। এভাবে পর্যায়ক্রমে আমরা পাঁচটি প্রজাতির প্রায় এক লক্ষ জিনকে সনাক্ত করতে সক্ষম হই। এ বিশাল তথ্যভান্ডার আন্তর্জাতিক ভাবে উন্মুক্ত এবং পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের যে কেউ হালদা নদীর মাছের এই ডাটাগুলো তাদের গবেষণা কাজে ব্যবহার করতে পারবে।

গবেষণার মূল উদ্দেশ্য
আমরা পাঁচটি বিষয়কে লক্ষ্য রেখে কাজ শুরু করি। প্রথম লক্ষ্যটি ছিলো কার্প মাছ সমূহ এবং ডলফিনের একটি ড্রাফ্ট জিনোম ডাটাবেস তৈরী করা। দ্বিতীয় লক্ষ্যটি ছিলো এ প্রজাতি গুলোর গুরুত্বপূর্ণ জিন সমূহ সনাক্তকরণের মাধ্যমে ভবিষ্যত বাণিজ্যিকিকরণের স্বার্থে হালদার ব্র্যান্ডিংয়ের কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় তথ্য বা উপাত্ত উদঘাটন করা। তৃতীয়ত, বিপন্ন প্রজাতির ডলফিনের সংরক্ষণের জন্য শারীরবৃত্তীয় তথ্য উপাত্ত সংশ্লিষ্ট জিনের তথ্যভান্ডার তৈরী করা। চতুর্থত, বিবর্তনের উৎস (ঊাড়ষঁঃরড়হধৎু ঙৎরমরহ) হিসেবে হালদার কার্প ও ডলফিনের জিনোমের তথ্যভান্ডার তৈরী। সর্বশেষ, হালদার কার্প ও ডলফিনের জীববৈচিত্র্য ও সংরক্ষণের স্বার্থে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষকদের মধ্যে সমন্বয় করা।

গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল
আমাদের গবেষণায় প্রায় ৭০০ গিগাবাইট প্রাথমিক ডাটা বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। এই বিশাল ডাটা ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে আমাদের সাধারণ ল্যাপটপ বা ডেস্কটপে ডাটাবিন্যাস সম্ভব ছিল না। চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অধ্যাপক তোফিক সায়ীদ, তাঁর দুটো উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ডাটা সার্ভার আমাদের ব্যবহারের অনুমতি দেন। তাদের কারিগরি সহযোগিতায় এই ডাটাগুলোকে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্ভারে প্রসেসিং করি। পর্যায়ক্রমে আমরা পাঁচটি প্রজাতির প্রায় এক লক্ষ জিন-প্রোটিনের অস্তিত্ব সনাক্ত করতে সক্ষম হই। এ বিশাল তথ্য ভান্ডার ভবিষ্যতের বিষদ গবেষণার জন্য বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের স্থানীয় গবেষকদের আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন গবেষণা সক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে মলিকিউলার জীবপ্রযুক্তি এবং কম্পিউটেশনাল বায়োলজির সমন্বিত গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।

গবেষণাটি যেসব সুফল বয়ে আনবে
হালদার কার্প জাতীয় মাছ এবং ডলফিনের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় সে সকল জিন এবং প্রোটিনসমূহের কার কী কাজ তা নিয়ে বিশাল গবেষণার সুযোগ আছে। বংশগত বা সংক্রামক রোগ নির্ণয়ের পাশাপাশি হালদার মাছের ডিম, রেণু এবং পোনাগুলোর কোয়ালিটি কন্ট্রোল বা মান নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা যদি জেনেটিক সিকোয়েন্স বেইজড ডায়গনস্টিক কিট তৈরি করতে পারি তাহলে আমরা সহজে হালদা ও অন্যান্য উৎসের পোনার পার্থক্য শনাক্ত করতে সক্ষম হব। এর ফলে, হালদা পাড়ের এবং সংশ্লিষ্ট অসংখ্য মৎস্যজীবীদের সমন্বয়ে মানসম্পন্ন পোনা উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং প্রকৃত রেণু সংগ্রহকারীদের প্রতারিত হওয়ার সম্ভবনা কমে যাবে। পাশাপাশি বংশগত গুণসম্পন্ন হালদার আদি প্রজাতির মাছের উৎপাদন বাড়াতে চাইলে আমাদের কিছু সুনির্দিষ্ট জিনকে টার্গেট করতে হবে।

গবেষণায় নিয়োজিত টিম
আমাদের গবেষণা দলে অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরীয়া এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির ৫ জন শিক্ষার্থী ও ২ বায়োইনফরমেটিশিয়ান ছিলেন। চবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ছিলেন সুমা আক্তার, নাজনীন ইসলাম, সাবিহা মুস্তফা অর্পা, আজলিনা কবির, আবদুল্লাহ আল আশেক এবং বায়োইনফরমেটিশিয়ানদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ শামসুর রহমান এবং এনামুল বাহার।

সম্ভবনার দুয়ার খুলেছে যতটা
আমাদের শনাক্তকৃত জিনগুলো এনালাইসিস করে কোন জিনগুলো মাছ ও ডলফিনের জৈবিক পদ্ধতি, কোন জিনগুলো কোষীয় কার্যাবলি এবং কোন জিনগুলো মলিকিউলার প্রসেসের জন্য দায়ী তা বের করা সম্ভব হয়েছে। এখন আমরা মাছ ও ডলফিনের কোন লোকেশনের জিনটি ব্যবহার করে ভবিষ্যতে এ সকল প্রাণীর মান উন্নয়ন সম্ভব তা বের করতে পারবো। মৎস সেক্টরে এ গবেষণাটি অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ কেননা আমরা কাজ করেছি একদমই আদি জাত নিয়ে যাদের পূর্বালোচনার মাধ্যমে নিশ্চিত হই যে, এদের বৃদ্ধি, স্বাদ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্যাচারী সহ অন্য যেকোন উৎসের তুলনায় অনন্য। ফলে, সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ও অত্যাধিক লাভজনক যেকোন উচ্চফলনশীল জাত তৈরীও সম্ভব হবে। আমাদের গবেষণাটি একটি বেসলাইন স্টাডি। যেটির মাধ্যমে সামনে নতুন নতুন গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

হালদায় গাঙ্গেয় ডলফিন আসার রহস্য
বিবর্তনবাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এ যে পৃথিবীর ডলফিন গুলোর আদি উৎস কোথায়। এ রহস্য উদঘাটনে বংশগতির প্রকৃত তথ্য জানা প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন জলজ পরিবেশের ডলফিনের জিনোম বিন্যাস সম্পর্কীত ডাটা যদি আমাদের কাছে থাকতো, তাহলে তাদের উৎস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব ছিলো। ভারতের সিন্ধু নদী ও গঙ্গা নদীতে ইরাবতী ডলফিন আছে। এসব ডলফিনের প্রজাতির মধ্যে কোথায় মিল-অমিল সেটা নিয়ে গবেষণা দরকার। তারা কয়শ বছর আগে একই উৎস থেকে ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলো গবেষণার ভালো রসদ। আমাদের এই ডাটা সেই উত্তরগুলো দিতে চেষ্টা করবে। যারা ইভোলুশনারি বায়োলজি নিয়ে কাজ করে তাদের বিশেষ সাহায্য করবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
এ গবেষণাটি নিয়ে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে। তবে আপাতত আমরা একটি জীবপ্রযুক্তি ভিত্তিক কিট ডেভেলপ করতে চাই যার মাধ্যমে হালদার মাছের রেণু এবং অন্য উৎসের মাছের রেণুর মাধ্যে পার্থক্য করতে পারি। এর ফলে, হালদার কার্প মাছের রেণু ক্রেতারা আর প্রতারণার স্বীকার হবেন না। অন্যদিকে, ডলফিন বিষয়ে আমাদের সাথে বাইরের গবেষকরা ইতোপূর্বে যোগাযোগ করেছেন। আমরা তাদের সাথেও যৌথভাবে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেছি। সবকিছু অনুকূলে থাকলে আমরা আরো অনেক কাজ করে দেশকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবো।

গবেষণার প্রতিবন্ধকতা
জেনোমিক গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো (উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সার্ভার, এনজিএস সিকুয়েন্সিং সুবিধা, প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব) বাংলাদেশে সহজলভ্য নয়। এছাড়াও, এ ধরনের কাজের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো, অর্থ সংকট। আমাদের টিম অনেকটা স্বেচ্ছাশ্রমেই কাজটি শেষ করেছে। তারপরও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়েছে। সামনের কাজগুলোর জন্যেও অনেক অর্থের দরকার রয়েছে।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১