আপডেট : ০৪ September ২০২১
পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্য কোনো দেশে আশ্রয় নিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মািয়ানমার থেকে আসা মানুষ, যারা রোহিঙ্গা নামে এদেশে বসবাস করছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয়ের চার বছর পূর্ণ হয়ে পাঁচ বছরে পড়েছে। আশ্রয়হীন মানুষের বড় অংশই এখন বাংলাদেশে বসবাস করছে। মিয়ানমারের এই হত্যাযজ্ঞের সময় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু আশা ছিল, এই সৃষ্ট সমস্যাটির একটি কার্যকর সমস্যা আন্তর্জাতিক মহল করবে। এখনো কার্যত এই সমস্যার কোনো টেকসই সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে পারেনি আন্তর্জাতিক মহল। এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা ভবিষ্যতে কোথায় থাকবে, তাদের সন্তানদের ভাগ্যে কী ঘটবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় পার হচ্ছে। মাঝেমধ্যে রোহিঙ্গা নিয়ে কিছু কথা শোনা গেলেও মূল সমাধান অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। এদিকে ক্রমেই এ দীর্ঘ বিষয়টি আর দীর্ঘতর হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে বিশ্বে আরো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে। আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এদের ভবিষ্যৎ কী হবে তার অস্থায়ী সিদ্ধান্ত হলেও স্থায়ী সমাধান হয়নি। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ইস্যুটিও এরকমই একটি আপাত অমীমাংসিত ইস্যু। যেখানে রোহিঙ্গা ফেরত যাওয়ার কথা, তাদের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। রোহিঙ্গারা যেখানে আশ্রয় নিয়েছে সেই উখিয়া, টেকনাফ এবং ভাসানচর থেকেও পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। তারা কেউ কেউ সাগর পাড়ি দিয়ে অন্য দেশে যাওয়ারও চেষ্টা করছে। সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের নৌকাডুবির ঘটনা ঘটছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় তারা প্রবেশেরও চেষ্টা করছে। কয়েকটি জেলা থেকে তাদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাটি ছিল মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। এখন তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেওয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সু চি সরকার এখন ক্ষমতায় নেই। এখন ক্ষমতায় রয়েছে সামরিক সরকার। গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় না থাকলেও জান্তা সরকারের সাথেই ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে এবং কাজে লাগাতে হবে আঞ্চলিক যোগাযোগ। কারণ বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা নিয়ে যে ইস্যু তৈরি হয়েছে তা সমাধান করতে হলে এর বিকল্পও নেই। ২০১৭ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়ংকর সহিংসতা শুরু করার পর থেকে রোহিঙ্গারা ধর্ষণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। মানবতার দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় প্রদান করে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে এসব রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়। তারপর থেকেই এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের আশ্রয়ে রয়েছে। কক্সবাজারের বন বিভাগের হিসাবমতে, রোাহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে সাড়ে ৬ হাজার একর বনভূমি বেদখল হয়ে গেছে, যা আমাদের পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আমাদের কৃষিজমির ওপরও চাপ সৃষ্টি হতে পারে। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও তা শুরু করা যাচ্ছে না। এদিকে রোহিঙ্গা শিবিরে মাদক, সন্ত্রাস নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে গোলাগুলি এবং নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতি বছর জন্মগ্রহণ করছে বহু শিশু। তাদের বড় হয়ে ওঠার জন্য একটি স্থায়ী পরিবেশ অর্থাৎ তাদের মাটির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বছর যাওয়ার সাথে সাথে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি পাবে। তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনিশ্চয়তা, কর্মসংস্থানের সংকটে নিজেদের মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে ফেলাসহ বিভিন্ন সমস্যা দীর্ঘতর হচ্ছে। এই অনিশ্চয়তার আশঙ্কা ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট। তবে এর সমাধানে শিঘ্রই কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় না। বরং সমস্যা দীর্ঘতর হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণ করেছে সরকার। সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। রয়েছে বসবাসের সবরকম সুযোগ-সুবিধা। তারপরও তারা সেখান থেকে পালাচ্ছে। গত বছর গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক খবরে দেখা যায়, গত তিন বছরে ক্যাম্প থেকে এরকম হাওয়া হয়ে যাওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। এর পেছনে রয়েছে এক শ্রেণির দালাল। তাদের সহায়তায় রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বিভিন্ন শ্রমমূলক কাজে যুক্ত হচ্ছে। এ সংখ্যা বাড়ছে। এসব রোহিঙ্গা কোথায়? কারণ ঝুঁকির বিষয় হলো এদের লোকালয়ে মিশে যাওয়ার মতো ঘটনা। এদের মধ্যে অনেকের অপরাধে জড়িয়ে পরার ঘটনা উদ্বেগ তৈরি করছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সে কাজে গতি আসেনি। মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং কোভিড-১৯ ইস্যু সামনে চলে আসায় যেটুকুও অগ্রগতি হয়েছিল সেটুকুও আড়ালে চলে গেছে। রোহিঙ্গাদের সেখানে ফেরা এবং নিরাপত্তা এই দুই বিষয় নিশ্চিত না করলে তাদের সেখানে যেতেও আগ্রহী করা যাবে না। রোহিঙ্গারা অনিচ্ছুক এই কারণে তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। কিন্তু এখানে কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসে। তা হলো কেন রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফেরত যেতে ইচ্ছুক নয়? নিজ বাসভূমে ফিরে যাওয়ার ব্যপারে রোহিঙ্গাদের ভেতর আস্থা কে তৈরি করবে? সমস্যার শুরু করেছে মিয়ানমার। তাহলে সমাধানও তাদেরই করতে হবে। তবে রোহিঙ্গাদের জন্য নিজ দেশে উপযুক্ত নিরাপদ পরিবেশ মিয়ানমার তৈরি না করতে পারলে এবং রোহিঙ্গাদের বিশ্বাস অর্জন করতে না পারলে তাদের ফেরানো কষ্টকর। কারণ অনিশ্চিত গন্তব্যে তারা যেমন যাবে না আবার তাদের সেখানে পাঠানোও যাবে না। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত, চীনসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ জাতিসংঘের। কারণ এই সমস্যাটি মানবিক বিপর্যয়ের একটি বড় উদাহরণ এবং বিশ্বের উচিত হবে তাদের নিজ বাসভূমে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করা। রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সবসময়ই ইতিবাচক ছিল। এখনো আছে। মানবিক কারণেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে। তবে দিন যাওয়ার সাথে সাথে রোহিঙ্গা নিয়ে বহুমুখী সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিশেষ করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম, রোহিঙ্গা গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং আরো ভয়ংকর মাদকের বিস্তার। একটি রাষ্টের যে দায়িত্ব ছিল তা মায়ানমার পালন করেনি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব দেশে বসবাসরত সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। মিয়ানমার তা করেনি। তার পরিবর্তে রাখাইনে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর এই নৃশংসতাকে ’গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে গাম্বিয়া। এটি ছিল আইনিভাবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি বিশাল অর্জন। কিন্তু প্রত্যাবাসন যেন শুরু হয় হয় করেও শেষ পর্যন্ত শুরু হয়নি। রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। কিন্তু তারপরও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বারবারই ঝুলে থাকছে। রোহিঙ্গারা নিরাপদ পরিবেশ না পেলে ফিরে যেতে ইচ্ছুক না। এই নিরাপদ পরিবেশ কতদিনে মিয়ানমার তৈরি করতে পারবে তা আদৌ নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ দেশটিতে এখন গণতান্ত্রিক পরিবেশই নেই। যখন সেই পরিবেশ ছিল তখনই কায়ক্রমে কোনো অগ্রগতি হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিষয়টি দীর্ঘায়িত হবে। এখন অপেক্ষা এবং কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার ছাড়া কোনো সমাধান রাতারাতি আসবে বলে মনে হয় না। মিয়ানমারে নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে তারা ফিরতে পারে। বিপরীতে আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় মিয়ানমারের ওপর রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার চাপ আন্তর্জাতিকভাবে অব্যাহত রাখা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। লেখক : সাংবাদিক sopnil.roy@gmail.com
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১