আপডেট : ০১ September ২০২১
আল্লাহ পৃথিবীতে অসংখ্য প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর কতককে কতকের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছেন। মর্যাদাপ্রাপ্ত অনন্য একটি সৃষ্টি হচ্ছে বনী আদম তথা মানুষ। পবিত্র কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘বাস্তবিকপক্ষে আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি এবং স্থলে ও জলে তাদের জন্য বাহনের ব্যবস্থা করেছি, তাদেরকে উত্তম রিজিক দান করেছি এবং আমার বহু মাখলুকের ওপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত-৭০) একদিকে মানুষকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করা হয়েছে। অন্যদিকে তাদের মাঝে রয়েছে মানবীয় দুর্বলতা। মানুষের মাঝে যেমন ভালো কাজ করার আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় তেমনি মন্দ কাজের প্রতিও তাদের প্রবণতা লক্ষণীয়। একই সাথে দ্বিমুখী দুটো বস্তু নিজের মাঝে ধারণ করে মানুষ চলতে থাকে আমৃত্যু। মন্দ কাজের প্রতি দুর্বলতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষকে দুর্বলরূপে সৃষ্টি করা হয়েছে।’ (সুরা নিসা, আয়াত-২৮) মানবীয় দুর্বলতার শিকার হয়েই মূলত আমরা দুনিয়ার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। আর ঠিক তখনই মানবজাতির চিরশত্রু শয়তান আমাদেরকে গোনাহের প্রতি প্ররোচনা দিতে থাকে। নফস উপর্যুপরি আল্লাহর অবাধ্যতার দিকে আহ্বান করতে থাকে। শয়তান ও নফসের এ সাঁড়াশি যৌথ আক্রমণে আমরা দুর্বল মানুষেরা পরাভূত হয়ে যাই। এক সময় স্রষ্টার অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে পড়ি।(নাউযুবিল্লাহ) শয়তান মানুষকে কখনো দারিদ্র্যের ভয় দেখিয়ে গোনাহে লিপ্ত করে। আবার কখনো সরাসরি অশ্লীলতা বেহায়াপনার দিকে আহ্বান করে। পক্ষান্তরে দয়াময় আল্লাহ মানুষকে ক্ষমা ও আপন দয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। আদরের সৃষ্টি দুর্বল মানুষের প্রতি তিনি মাগফিরাত তথা ক্ষমার হাতকে সমপ্রসারিত করে রাখেন তাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগ পর্যন্ত। ইরশাদ হয়েছে, ‘শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং তোমাদেরকে অশ্লীলতার আদেশ করে আর আল্লাহ তোমাদেরকে স্বীয় মাগফিরাত ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আল্লাহ অতি প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-২৬৮) দুর্বল মানুষ গোনাহে লিপ্ত হয়ে সফলতার পথ থেকে ছিটকে যায়। অজানা অন্ধকার উপত্যকায় উদাসীন হয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে। দয়াময় আল্লাহ আবারও সেই উদাসীন পথহারা মানুষকে সঠিক পথে ফিরে আসার সুযোগ দেন। গোনাহ থেকে মুক্ত হয়ে সফলতার পথে পা বাড়ানোর দিকনির্দেশনা দেন। গোনাহের অন্ধকারাচ্ছন্ন উপত্যকা ছেড়ে আল্লাহর আনুগত্যপূর্ণ আলোকময় পথে যাত্রার নামই হচ্ছে তাওবা। যার শাব্দিক অর্থ ফিরে আসা। আঁধার থেকে আলোর দিকে অভিযাত্রা। তাওবার মাধ্যমে একজন মানুষ ব্যর্থতার অতল গহ্বর থেকে সফলতার রৌদ্রোজ্জ্বল রাজপথে উঠে আসে। এ কারণেই কোরআন মাজিদে তাওবাকে সফলতার উপায় বলে অভিহিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে তাওবা করো, যাতে তোমরা সফলতা অর্জন করতে পার।’ (সুরা নূর, আয়াত-৩১) একজন মানুষ যখন গোনাহে লিপ্ত হয় তখন সাধারণত তার মাঝে এক নৈরাশ্য কাজ করে। হতাশা তাকে ছেয়ে ফেলে। এই সুযোগে শয়তান তাকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়ার রসদ যোগায়। অনেকে তখন নিরাশ হয়ে যায়। ভেঙে পড়ে। আল্লাহতায়ালা তখন সেই ব্যক্তিকে তার রহমত থেকে নিরাশ না হওয়ার নির্দেশনা দেন। তিনি সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন মর্মে সান্ত্বনার বাণী শুনান। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী বলে দাও, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজ সত্তার ওপর সীমালংঘন করেছে, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাপ ক্ষমা করেন। নিঃসন্দেহে তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা যুমার, আয়াত-৫৩) আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ক্ষমার এই অফুরন্ত ধারা অব্যাহত থাকে ব্যক্তির মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। জীবন রবি পশ্চিম দিগন্তে অস্তমিত হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাওবার সুযোগ থাকে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহতায়ালা তাওবা কবুলের যে দায়িত্ব নিয়েছেন তা কেবল সেই সকল লোকের জন্যে, যারা অজ্ঞতাবশত কোনো গোনাহ করে ফেলে, তারপর জলদি তাওবা করে নেয়। সুতরাং আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত, প্রজ্ঞাময়। তাওবা কবুলের বিষয়টি তাদের জন্য নয়, যারা অসৎকর্ম করতে থাকে। পরিশেষে তাদের কারো যখন মৃত্যুক্ষণ এসে পড়ে, তখন বলে, এখন আমি তাওবা করলাম এবং তাদের জন্যও নয়, যারা কুফর অবস্থায় মারা যায়। এরূপ লোকদের জন্য তো আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।’ (সুরা নিসা, আয়াত-১৭, ১৮) ইমাম আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনে শরফ আন নববী (রহ.) (জন্ম-৬৩১ হি. মৃত্যু-৬৭৬ হিজরি) বলেন, উলামায়ে কেরাম বলেছেন, আল্লাহতায়ালার দরবারে তাওবা কবুল হওয়ার শর্ত তিনটি। ‘এক. গোনাহ সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা। দুই. গোনাহের কারণে লজ্জিত হওয়া। তিন. ভবিষ্যতে গোনাহ না করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করা।’ গোনাহের সম্পর্ক যদি কোনো ব্যক্তির সাথে হয়ে থাকে যেমন, কাউকে কষ্ট দিল, অন্যায়ভাবে কারো সম্পত্তি আত্মসাৎ করে নিল, তাহলে এ ক্ষেত্রে উপরিউক্ত তিনটি শর্তের পাশাপাশি আরো একটি শর্ত পূরণ করতে হবে। তা হচ্ছে, যাকে কষ্ট দেওয়া হয়েছে তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। আত্মসাৎকৃত ধনসম্পত্তি তার হকদারের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। (রিয়াযুস সালিহীন, পৃষ্ঠা ১৪, দারুল হাদিস কায়রো মিসরের সংস্করণ) একজন মানুষ যখন গোনাহের অন্ধকার থেকে তাওবার আলোকময় রাজপথে পদচারণা শুরু করে তখন আল্লাহতায়ালা ভীষণ আনন্দিত হন। কতটুকু আনন্দিত হন তার খানিকটা বিবরণ হাদিস শরিফে পাওয়া যায়। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, একজন মানুষ যখন তাওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে তখন আল্লাহ ওই ব্যক্তির চেয়েও বেশি খুশি হন, বিজন মরুভূমিতে খাবার পানীয়সহ যার বাহন হারিয়ে যায়। আর ওই ব্যক্তি নিশ্চিত মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকে। অতঃপর কোনো একটি গাছের নিচে এসে হতাশ লোকটি ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে জেগে লোকটি দেখে তার বাহন তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি আনন্দের আতিশয্যে ভাষা হারিয়ে প্রলাপ বকতে বকতে বলে, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার গোলাম। আমি তোমার প্রভু।’ খুশির আধিক্যে তার ভাষা এলোমেলো হয়ে যায়। একজন বান্দার তাওবায় আল্লাহ ওই ব্যক্তির চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি আনন্দিত হন। (সহিহ বুখারি : ১১/৬৩০৯, সহিহ মুসলিম : ৪/২১০৫) রাতদিন সব সময় আল্লাহ তার বান্দার জন্যে ক্ষমার হাতকে সমপ্রসারিত করে রাখেন। প্রভুর মাগফিরাত মানুষকে প্রতিনিয়ত হাতছানি দিয়ে ডাকে। হজরত আবু মুসা আব্দুল্লাহ ইবনে কায়েস আশয়ারী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা রাতের বেলায় নিজের ক্ষমার হাতকে সমপ্রসারিত করে রাখেন, যাতে দিনের বেলায় যারা গোনাহ করে ফেলেছে তারা যেন তাওবা করে নিতে পারে। এমনিভাবে দিনের বেলায়ও তিনি আপন মাগফিরাতের হাতকে বিস্তৃত করে রাখেন, যাতে রাতের গোনাহগাররা তাওবা করে তার দিকে ফিরে আসে। এই সুযোগ পশ্চিম দিকে সূর্যোদয় তথা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।’ (সহিহ মুসলিম : ৪/২১১৩, মুসনাদে আহমদ : ৪/৩৯৫) একজন মানুষের মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাওবার দরজা খোলা থাকে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহতায়ালা তার বান্দার তাওবা কবুল করে থাকেন, যতক্ষণ না ওই বান্দার মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। (জামে তিরমিযি : ৫/৩৫৩৭, ইমাম তিরমিযি [রহ.] হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।) তাই আসুন আমরা হূদয়ের জানালা খুলে দিই। দয়াময় আল্লাহর ডাকে সাড়া দিই। গোনাহের নোংরা দুর্গন্ধযুক্ত ভূখণ্ড থেকে তাওবার পবিত্র সুগন্ধময় রৌদ্দোজ্জ্বল প্রান্তরে যাত্রা করি। আঁধার থেকে আলোর দিকে ফিরে আসি। তাওবার সুরভিত নয়নাভিরাম উদ্যানে আপনাকে স্বাগতম। লেখক : আব্দুল্লাহ আলমামুন আশরাফী খতীব, আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১