আপডেট : ০৯ August ২০২১
ফারিয়া ইয়াসমিন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অন্যতম প্রধান ভূমিকা রাখে গাছপালা। একটা দিককে এগিয়ে নিতে গেলে অন্যদিকে পেছনে ফেলতে হয়। ঠিক তেমনি কোনো কিছুর উন্নতি করতে গেলে অপর একটা জিনিসের ক্ষতি হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে ক্ষতিটা যদি এমন কোনো প্রয়োজনীয় উপাদানের হয় যে তার সাথে সরাসরি যুক্ত আছে আমাদের মনুষ্যজাতির অস্তিত্ব, তাহলে সেই উন্নয়ন স্থবির করাই শ্রেয়। বৃক্ষনিধন আমাদের দেশে নতুন কোনো বিষয় নয়, প্রতিনিয়ত মানুষ বন উজাড় করে চলেছে। কেউ সচেতন নয় বন উজাড় করার ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে। দিগন্তজুড়ে সবুজের সমারোহ এখন আর চোখে পড়ে না তেমন। বৃক্ষ নিধন করে সভ্য নগর পরিকল্পনার নামে গড়ে উঠছে বড় বড় অট্টালিকা। উন্নয়নের নামে কেন গাছ কাটা হবে? পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে দায় কার? বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, আর অন্যদিকে পরিবেশ রক্ষা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ভয়াবহ খারাপ। আগের কিছু সমীক্ষা বিবেচনা করলেই তা বোঝা যায়। ২০১৯-এর তালিকায় পরিবেশ রক্ষার বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের গড় স্কোর ২৯.৫৫। ২০১৬ সালের তালিকায় বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪১.৭৬। প্রায় দ্বিগুণ আকারে নিচে নামছি আমরা। ২০১৪ সালের তালিকায় ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৯। জলবায়ু পরিবর্তনে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হয়েও সুন্দরবনের সন্নিকটে এবং পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় পরিবেশ বিধ্বংসী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে নির্ভরশীলতা অব্যাহত রাখার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষা ও বন সংরক্ষণের বিপরীত নীতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সরকার ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন ৮০ শতাংশ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও বন নিধনের চিত্র এখনো কমেনি। বিভিন্ন উছিলায় ধ্বংস করা হচ্ছে আমাদের বনভূমি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে ঘিরে ফেলা হয়েছে বিভিন্ন কোম্পানি দিয়ে। যেখানে এই বনকে সুরক্ষা বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখা উচিত, সেখানে উল্টো বিভিন্ন কারখানা বসছে এর চারদিকে। সুন্দরবনের কাছে গড়ে তোলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত হিসেবে স্বীকৃত কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কারখানা প্রকল্প। এভাবেই প্রতিটি জায়গায় সবুজের সমারোহ বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের নামে চাপা পড়ে যাচ্ছে অপরাধীর নামগুলো। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশ বার্ষিক বন উজাড় হওয়ার হার বৈশ্বিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। গত সতেরো বছরে বাংলাদেশ প্রায় ৬৬ বর্গ কিলোমিটার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইন ফরেস্ট ধ্বংস করা হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় দেশের এমন খারাপ অবস্থানের কথা চিন্তা করেও আমরা সচেতন হই না। আমরা এখনো সুযোগ পেলেই বৃক্ষনিধনে একত্রিত হয়ে যায়। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এক অঞ্চলের গাছ কাটা রোধ করতে করতে অন্য কয়েকটি অঞ্চল মরুভূমির ন্যায় পতিত হচ্ছে। এগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই তখন উন্নয়নের কথা বলা হয়। আসলে উন্নয়ন হচ্ছে নাকি উন্নয়নের নামে অজুহাত দিয়ে এসব বৃক্ষ নিধনের পরিকল্পনা চলছে? সম্প্রতি নজরে আসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বৃক্ষনিধনের ঘটনাটি। গাছপালায় ঘেরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যানজট শহরে এক প্রকার প্রাণস্বরূপ। কিন্তু সেখানে গাছ কেটে উন্নয়নের নামে প্রাণহীন করে দেয়া হচ্ছে এই উদ্যানকে। এই উদ্যানে অবসর সময় কাটাতে আসে হাজার হাজার মানুষ। সেই সবুজের সমারোহ নষ্ট করতে ব্যস্ত সুযোগসন্ধানী কিছু মানুষ। উদ্যানটিতে ঢুকলেই আগে চোখে পড়তো গাছগুলোর সৌন্দর্য। আর এখন উদ্যানটিতে ঢুকলেই দেখা মেলে মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা কাটা গাছের গুঁড়ি, আর কাটার জন্য চিহ্নিত করা গগনচুম্বী সব গাছ। রেস্টুরেন্টের স্থাপনার পাশাপাশি ওয়াকওয়ে তৈরির জন্যও চলছে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি। এটি করতেও কাটা পড়ছে শতাধিক গাছ। উদ্যানের বিভিন্ন স্পটে পড়ে থাকা বড় বড় গাছের গুঁড়িগুলো জানান দেয় কিছু সুবিধাভোগী মানুষের কথা, যারা উন্নয়নের নামে এমন বৃক্ষনিধন বহুকাল ধরে করে আসছে। এমন ঘটনা যে শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই ঘটছে তা নয়, পুরো দেশেই গাছ কেটে চলছে নির্মাণকাজ। আর এই কাজের জন্য সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত অজুহাত হিসেবে দাঁড়াচ্ছে ‘উন্নয়ন’। অথচ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের জীবন। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে তার প্রভাব সবকিছুর উপরে পড়বে। কিন্তু এ কথা বিবেচনা না করে বন উজাড় করে নিত্যনতুনভাবে তৈরি করা হচ্ছে অবকাঠামো। এ নিয়ে সরকারের নানান নির্দেশনা আছে, আছে পরিবেশ আইন। কিন্তু তারপরও থেমে নেই বৃক্ষনিধন। অপরাধকে আইনি খাতায় নিয়মের বেড়াজালে ফেলে বেঁচে যাচ্ছে এসব অপরাধী। শুধু বৃক্ষনিধনের সাথে জড়িত অপরাধী নয়, আমরাও চোখ বন্ধ করে অপরাধীকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছি। কিছুদিনের জন্য প্রতিবাদে গর্জে ওঠে পুরো শহর, আবার শান্ত হয়ে যায় আগের মতো। এসবের মাঝেই পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। নতুন করে বৃক্ষরোপণের চিন্তা না থাকলেও প্রতিনিয়ত গাছ কেটে ব্যবসায়িক কাজে লাভবান হওয়ার চিন্তা সবার মাথায় আছে। যদিও এরই মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কেটে ফেলার প্রতিবাদে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়েছিল। কিন্তু গাছ কাটা বন্ধ হয়নি। শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বৃক্ষনিধনের ঘটনাই নয়, সম্প্রতি আরও কিছু বৃক্ষনিধনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। যেগুলোর ফলে শহরের বিভিন্ন জায়গা বৃক্ষশূন্য হয়ে যাবে। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, গাবতলী বাস টার্মিনালে বৃক্ষনিধন করে তৈরি হবে টয়লেট এবং কাউন্টার। এমনই একটি পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে জানা যায়। বারবার এই বৃক্ষনিধনের পেছনে উন্নয়নের কারণ দেখানো হয়। তবে বৃক্ষের মতো প্রয়োজনীয় উপাদান ধ্বংস করে কোন উন্নয়ন সাধিত করা হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। জনজীবনের সুস্থতা কামনা করার মতো উন্নয়ন আর হয় না। অথচ তার জন্য প্রয়োজন সবুজের সমারোহ। গাবতলী বাস টার্মিনালের বাগানের গাছগুলো কেটে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। গাছ কেটে সেখানে বাস কাউন্টার ও যাত্রীদের জন্য টয়লেট নির্মাণ করা হবে বলে জানানো হয়। ইতোমধ্যে বাগানটি টিন দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। লকডাউন উঠে গেলে গাছগুলো কেটে ফেলা হবে বলে জানিয়েছেন, গাবতলী বাস টার্মিনালের কয়েকজন নিরাপত্তা প্রহরী। চোদ্দ বছর আগে গাবতলীতে আধুনিক বাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়। টার্মিনালে প্রায় তিনশ বাস কাউন্টারের পাশাপাশি যাত্রীদের জন্য রয়েছে বিশ্রামাগার ও আধুনিক টয়লেট। টার্মিনালে প্রবেশ মুখে ডান পাশে একটি বাগান রয়েছে। প্রায় ৩শ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪৫ ফুট প্রস্থের বাগানটিতে প্রায় একশ বৃক্ষ রয়েছে। বাগানের আমড়া গাছে আমড়া ধরেছে। রয়েছে তেঁতুল, আম, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নিম, মেহগনি, বাগান বিলাস, জামসহ নানা প্রজাতির গাছ। কোনো কোনো গাছের বয়স ১৪ বছরেরও বেশি। আর এসব পুরাতন গাছ কাটার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যেগুলো ক্লান্ত যাত্রীদের তপ্ত রোদ থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে। আর টার্মিনালের সামনে প্রধান সড়ক থেকে দেখলে মনে হয় যে, সবুজ গাছে ঘেরা বাস টার্মিনাল। শহরের বুকে সবুজের সমারোহ খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর। তারই মধ্যে যে কয়েকটি জায়গায় চোখে পড়ে সবুজের সমারোহ, সেখানে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুনভাবে উন্নয়নের নামে অজুহাত দেখিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে গাছ কাটার। বাস টার্মিনালটিতে যাত্রীদের জন্য টয়লেটের ব্যবস্থা থাকার পরও কেন অপ্রয়োজনীয় নির্মাণের জন্য এতগুলো গাছ কাটা হবে? বাস্তুসংস্থানকে হুমকির মুখে ফেলে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া নিতান্তই নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। টার্মিনালের ভিতরে যাত্রীদের বিশ্রামাগারে রয়েছে আধুনিক টয়লেট। কিন্তু সব টয়লেট নোংরা। পরিষ্কার না করায় পুরো টার্মিনালে এক ধরনের বিশ্রী গন্ধ জুড়ে থাকে। টার্মিনাল ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও টয়লেটগুলো পরিষ্কার করা হয় না। টয়লেটগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখলেই যাত্রীরা সুযোগসুবিধা পাবেন। তার জন্য অতিরিক্ত বৃক্ষনিধন করে কাউন্টার ও টয়লেটের ব্যবস্থা করার প্রয়োজন হবে না। উন্নয়নের নামে এই বৃক্ষনিধন মেনে নিলে ভবিষ্যতে বিপর্যয় নেমে আসবে। আগে পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন তারপর অবকাঠামো নির্মাণ। পরিবেশ সুরক্ষিত না করে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় না। তাই আমাদের প্রতিবাদ শুধু বৃক্ষনিধনের জন্য না হয়ে বৃক্ষ রোপণেও উদ্যোগী হতে হবে। রাজধানীর বুকে এক টুকরো বাগান বা সবুজ সমারোহের যে কত মূল্য তা শুধু তারাই জানে, যারা সেখানে বসবাস করে। এখন প্রশাসনকে রাজধানীর এই বৃক্ষনিধন রোধ করে উন্নয়নের চর্চা বন্ধ করতে হবে। নইলে বছরের পর বছর উন্নয়নের নামে বৃক্ষনিধনের মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয় হবে মানবজাতির জন্য মৃত্যুর শামিল। লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১