আপডেট : ০৭ August ২০২১
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ বিশ্বজুড়ে প্রাণঘাতী মহামারি করোনায় আতঙ্কিত হয়ে থমকে যাচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। গৃহবন্দি জীবন কাটাচ্ছে বিশ্বের অনেক জনবহুল দেশ ও শহরের মানুষ। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির কারণে দেশের ব্যবসায়ীরা যেমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার বিত্তশালী স্বাবলম্বীদের চাহিদার তুলনায় বেশি কেনাকাটায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ। খাদ্য মজুত ও আতঙ্ক সৃষ্টির কারণে একদিকে যেমন বিপন্ন হচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা অন্যদিকে একশ্রেণির মানুষ অভাবের তাড়নায় স্ত্রী-সন্তানদের ন্যূনতম চাহিদাও মেটাতে পারছে না। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী কিংবা বিত্তশালীর খাদ্য মজুত ও আতঙ্ক সৃষ্টিতে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী? খাদ্যদ্রব্য মজুত করা অথবা তা বাজার থেকে তুলে নিয়ে দাম বাড়ানো এবং অধিক মুনাফার প্রত্যাশা করাকে ইসলাম অবৈধ করেছে। হানাফি মাজহাব মতে তা মাকরূহে তাহরিমি (হারাম সমতুল্য) হলেও অন্যান্য মাজহাব মতে এটি হারাম। এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং অনেক মানুষ দুর্গতির মধ্যে পতিত হয়। এ ধরনের কাজ মানুষের কষ্টকে বাড়িয়ে দেয়। তাই ইসলাম এ প্রকার কাজকে হারাম ঘোষণা করেছে। এ প্রসঙ্গে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যশস্য মজুত রাখে, আল্লাহপাক তার ওপর দরিদ্রতা চাপিয়ে দেন।’ (আবু দাউদ : ৫৫)। ব্যবসায়িক পণ্য বিক্রি না করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বর্ধিত মুনাফা আদায়ের প্রচেষ্টা একটি সামাজিক অপরাধ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে খাদ্যশস্য গুদামজাত করে সে অভিশপ্ত।’ (ইবনে মাজাহ) তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার মজুত রাখে, সে আল্লাহর জিম্মা থেকে বেরিয়ে যায়।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ২০৩৯৬)। অন্য হাদিসে এসেছে : ‘যে ব্যক্তি খাদ্যশস্য গুদামজাত করে সে অপরাধী।’ (আল মু’জামুল কাবির : ১০৮৬) তবে গুদামজাত পণ্য যদি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু না হয় কিংবা মানুষ এর মুখাপেক্ষী না হয় অথবা এসব পণ্য চাহিদার অতিরিক্ত হয় বা গুদামজাতকারী বর্ধিত মুনাফা অর্জনের অভিলাষী না হয়, তাহলে এসব অবস্থায় পণ্য মজুত রাখা অবৈধ নয়। আর সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে দাম বাড়ানোর লক্ষ্যে খাদ্য মজুত করা ইসলামের দৃষ্টিতে ভয়াবহ অপরাধ। এ ধরনের কুৎসিত চিন্তার মানুষকে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য-সুন্দরের ধর্ম ইসলামের বহির্ভূত বলে ঘোষণা করেছেন। হজরত মামার (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জনগণের জীবিকা সংকীর্ণ করে যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করবে সে বড় অপরাধী। আর জেনে রাখ! সে পাপী হিসেবে আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে। (মুসলিম : ১৬০৫, তিরমিজি : ১২৬৭)। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘গুদামজাতকারী কতই না ঘৃণিত মানুষ। আল্লাহতায়ালা দ্রব্যমূল্য কমিয়ে দিলে সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। আর বাড়িয়ে দিলে সে আনন্দিত হয়। (সুয়াবুল ইমান : ১০৪৪৫, মেশকাত : ২৭৭১) হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখবে, (এর দ্বারা মানুষকে কষ্ট দেবে), সে এ সম্পদ দান করে দিলেও তার গুনাহ মাফের জন্য যথেষ্ট হবে না। (মেশকাত : ২৭৭২)। খাদ্যদ্রব্য গুদামজাতকারী সম্পর্কে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমদানি করবে সে রিজিকপ্রাপ্ত হবে। আর যে গুদামজাত করবে, সে অভিশপ্ত হবে। (ইবনে মাজাহ : ২১৪৪, সুনান দারেমি : ২৪৬৪) ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। শহরের মানুষ দুবেলা ভাত খেলেও গ্রামের মানুষের তিন বেলাই ভাত চাই। ভাত হয় চাল থেকে। চাল আসে ধান থেকে। ধান আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। আল্লাহর মেহেরবানিতে চাষাবাদের জন্য এ দেশের জমিনের উর্বরতা ঈর্ষণীয় তো বটেই, সঙ্গে উপমাযোগ্যও। তাই তো এ দেশের মানুষ খুব দুর্ভিক্ষ ছাড়া কখনো ভাতের অভাবে পড়েনি। না খেয়ে মরেনি। ভাত আর ভাতের মাড় খেয়ে সহজে এ দেশের মানুষ জীবন ধারণ করত হাসিমুখে। আজ থেকে পনেরো বছর আগেও এমন দৃশ্য ছিল ঘরে ঘরে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে বদলেছে জীবনযাত্রার মান, খাদ্যাভ্যাসেও এসেছে নানা পরিবর্তন। কিন্তু ভাতের স্থান আছে আগের জায়গায়ই। নিত্য প্রয়োজনীয় এ খাদ্যের দাম এখন আকাশচুম্বী। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই চালের বাজারে গুজব উঠেছে, বন্যার কারণে ধান উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, তাই চালের সংকট দেখা দিয়েছে। কেজি প্রতি চালের দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। নিত্য এ খাদ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এক কেজি মোটা চাল ৫০ টাকায় কিনতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে মধ্যবিত্তদেরও। এককথায় চরম অস্থির অবস্থা চলছে চালের বাজারে। এই যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, এর জন্য বন্যা নয়, দায়ী অন্য কিছু। একদল অসাধু ব্যবসায়ী বন্যার অজুহাতে চাল মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। পাইকারি ও খুচরা বাজারে পড়েছে এর বাজে প্রভাব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযোগে মিলেছে এর সত্যতা। কয়েকটি জেলায় পাওয়া গেছে চালের বিশাল মজুত। প্রমাণ হয়েছে, আজকের করোনা মহামারি সময় বাজারের অস্থিরতার নেপথ্যে অসাধু মজুতদারদের কারসাজিই বড় ভূমিকা পালন করছে। ধর্ম ও মানবিকতা কোনো দিক থেকেই মজুতদাররা সমর্থনযোগ্য নয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ব্যবসায়িক কার্যক্রম : ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চা এবং দ্বীনি দাওয়াত এবং আল্লাহর ইবাদতের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় মসজিদ নির্মাণ করেন। পাশাপাশি মানুষের অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মদিনায় তিনি ইসলামী বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজেই বনু কায়নুকার বাজারটি পরিচালনার দায়িত্বভার নিয়েছিলেন। এ বাজারটির বৈশিষ্ট্য ছিল, এখানে কোনো রকম ধোঁকা-প্রতারণা, ঠকবাজি, মাপে কম-বেশি করার বা পণ্যদ্রব্য মজুত অথবা আটক করে কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি করে জনগণকে কষ্ট দেওয়ার সুযোগই ছিল না।আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন এক বিক্রেতার খাদ্যের স্তূপের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি তার হাত ওই খাদ্যের স্তূপে প্রবেশ করান, এতে তার হাত ভিজে গেল এবং অনুপযুক্ত খাদ্যের সন্ধান পেলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘হে খাদ্য বিক্রেতা! এগুলো কী?’ তখন সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! খাদ্যগুলো বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি এই ভিজা খাদ্যগুলো ওপরে রাখনি কেন, যাতে সবাই তা দেখে নিতে পারে? যে ব্যক্তি কাউকে ধোঁকা দেবে সে আমার উম্মত নয়।’ (মুসলিম, হাদিস নং: ১০২) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন নামাজের জন্য বের হয়ে দেখেন, লোকজন কেনাবেচা করছে। তখন তিনি তাদের ডেকে বলেন, ‘হে ব্যবসায়ী লোকেরা! কিয়ামতের দিন কিছু ব্যবসায়ী মহা পাপীরূপে উঠবে; তবে তারা নয়, যারা আল্লাহকে ভয় করে, সততা, বিশ্বস্ততা সহকারে ব্যবসা করে।’ (তিরমিজি, হাদিস নং: ১২১০) অন্য হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘হে ব্যবসায়ীরা! তোমরা মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কারবার থেকে অবশ্যই দূরে থাকবে।’ (তিবরানি) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও সাহাবায়ে কেরামের সততা ও ন্যায়-নিষ্ঠার কারণে মদিনার বাজার ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাজার। যেখানে জগদ্বিখ্যাত সাহাবি ও ব্যবসায়ী উসমান ইবনে আফফান (রা.) ও আবু আউয়ুব আনসারিসহ (রা.) আরো অন্যান্য সাহাবিরা ব্যবসা করতেন। যারা নৈতিকতা ও নিষ্ঠাপূর্ণ ব্যবসার পাশাপাশি ইবাদত-বন্দেগি ও দান-সেবার ক্ষেত্রেও ছিলেন সর্বাগ্রে। ইবাদত কবুল হওয়ার শর্ত হালাল রিজিক। যারা পণ্য মজুদের মাধ্যমে হারাম পথের অর্জিত সম্পদ কুক্ষিগত করছে, তারা ইবাদত-বন্দেগি যতটুকু করছেন, হারাম উপার্জনের কারণে তা কি বিফলে যাচ্ছে না? ব্যবসা করতে নিষেধ নেই। তবে তা সীমার মধ্যে হতে হবে। সততার সঙ্গে হতে হবে। অন্যথায় পরকালে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কেয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহা অপরাধী হিসেবে উত্থিত হবে। তবে যারা আল্লাহকে ভয় করবে, নেকভাবে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যবসা করবে তারা ব্যতীত।’ (তিরমিজি : ১২১০)। তাই যাদের কারণে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি হয় তারা সত্বর সুপথে ফিরবেন এটাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা। পরিশেষে আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সব ব্যবসায়ী কিংবা বিত্তশালীদের খাদ্য মজুত করা থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। গরিব-অসহায় ও নিম্নবিত্তদের দান-সাদকা করে সম্পদ ও হায়াতে বরকত লাভের তাওফিক দান করুন। গুজব ছড়ানোর মতো হারাম কাজ থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। কোরআন-বিধানগুলো যথাযথ মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক : এম এ কামিল হাদিস, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা drmazed689@gmail.com
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১