আপডেট : ১৬ July ২০২১
শাহজাহান আবদালী নবাব স্যার সলিমুল্লাহর উদ্যোগে এবং ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জনের অনুমোদনে এদেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়ন এবং এর কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। আমাদের পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে গঠিত নতুন প্রদেশের রাজধানী হয় ঢাকা। আর বেসরকারিভাবে নতুন প্রদেশের মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুর। ১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গের এক বছর পূর্তি অনুষ্ঠানটি খুব জাঁকজমকভাবে পালিত হয় ঢাকার শাহবাগে। সেদিন উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৫০০ ডেলিকেটসহ চার হাজার লোকের উপস্থিতিতে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’। এ সংগঠনের স্যার আগা খান সভাপতি এবং সৈয়দ হাসান বিলগ্রামিকে সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত করা হয়। বয়সে সবার চেয়ে কনিষ্ঠতম বলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ নিজে ষষ্ঠ সহসভাপতির পদটি গ্রহণ করেন। তারপর থেকে এদেশে ব্যাপক উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। কিন্তু কলকাতার কিছু হিন্দু কংগ্রেস নেতা, বুদ্ধিজীবীসহ সুবিধাবাদী হিন্দু-মুসলিম এলিট শ্রেণির ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লির দরবারে ব্রিটিশ ভারতের সম্রাট পঞ্চম জর্জ এক ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গ বাতিল করে দেন। সেদিনই লর্ড হার্ডিঞ্জ নবাব স্যার সলিমুল্লাহকে ‘গ্রান্ড কমান্ডার অব দ্য ইন্ডিয়ান আম্পায়ার’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তাৎক্ষণিকভাবে স্যার সলিমুল্লাহ বলে উঠলেন, স্যার বঙ্গভঙ্গ বাতিল করে আমাকে উপাধি দিলেন বটে, কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে আমার গলায় একটি কাঁটার মালা পরালেন। আমি দেশে গিয়ে কী জবাব দেব? সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম লীগের সভাপতি স্যার আগা খান ও ধনবাড়ির জমিদার নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী স্যার সলিমুল্লাহকে বুঝিয়ে বললেন, আপনি যদি এভাবে প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করেন তাহলে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। ঢাকায় এসে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন। তার মানসিক বিপর্যয়ের খবর শুনে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় সফরে এলেন। লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করতে যান নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ অনেকে। সেদিন লর্ড হার্ডিঞ্জকে বঙ্গভঙ্গের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ঢাকাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। সেইসঙ্গে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সমস্ত জায়গা দেবেন বলে প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হন। তারপর ঢাকার শাহবাগে ২ ফেব্রুয়ারি লর্ড হার্ডিঞ্জকে জাঁকজমকভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। লর্ড হার্ডিঞ্জ সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দেন। তারপর তিনি ভারত সচিবের নিকট অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব পাঠান। সেই প্রস্তাব অনুমোদিত হয় ১৯১২ সালের ৪ এপ্রিল। ২৭ মে বঙ্গীয় সরকার কর্তৃক ব্যারিস্টার আর নাথানকে সভাপতি এবং ডিএস ফ্রেজারকে সাধারণ সম্পাদক করে নাথান কমিশন গঠন করা হয়। নাথান কমিশনের সদস্যরা হলেন—নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নবাব সিরাজুল ইসলাম, ড. রাসবিহারী ঘোষ, আনন্দচন্দ্র রায়, জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপাল ললিত মোহন চট্টোপাধ্যায়, ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল ডব্লিউ এটি আচার্য, জি ডব্লিউ কুলচার, মোহাম্মদ আলী, ঢাকা মাদরাসার তত্ত্বাবধায়ক শামসুল উলামা আবু নসর ওয়াহিদ, প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপাল এইচ ডব্লিউ পিক, সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল সতীশচন্দ্র আচার্য প্রমুখ। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিশনের ইতিবাচক প্রতিবেদন। সে বছর ডিসেম্বর মাসে এটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৪ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এর কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। ফলে এদেশের মানুষ হতাশার মধ্যে পড়ে। এর মধ্যে ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি নবাব স্যার সলিমুল্লাহ মাত্র ৪৩ বছর ৭ মাস বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুতে এদেশে মানুষের মনোবল ভেঙে যায়। স্যার সলিমুল্লাহর অসমাপ্ত কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে বাস্তবায়ন করেন নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সকল সদস্যের কাছে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল পাসের আহ্বান জানান। ১৯১৭ সালের স্যাডলার কমিশনের ইতিবাচক প্রতিবেদনের পর ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ ভারতীয় আইনসভা কর্তৃক পাস হয় ‘দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট ১৯২০’। এ আইনের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবায়নের ফলাফল হিসেবে ১৯২১ সালের ১ জুলাই তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী ও তিনটি আবাসিক হল নিয়ে শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা। ফিলিপ জোসেফ হাটর্গ প্রথম ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনা করেন। পাশাপাশি তার স্ত্রী সাহিত্যিক লেডি মাবেল হাটর্গের অবদান ছিল প্রশংসনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের তিনি ঘোড়ার গাড়ির মাধ্যমে বাসাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। ভারতবর্ষে লেখক হিসেবে তার ছিল সুখ্যাতি। লর্ড রোনাল্ডসে ১৯১৭ হতে ১৯২২ পর্যন্ত বাংলার গভর্নর থাকাকালে নবাব সৈয়দ শামসুল হুদাকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার আজীবন সদস্য ঘোষণা করেন। সৈয়দ শামসুল হুদার সুপারিশে স্যার এ এফ রাহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট হিসেবে মনোনীত করা হয়। তিনি এর আগে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফসি টার্নার, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, জি এইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিউ এ জেনকিন্স, পল্লীকবি জসীম উদদীন, কবি মোহিতলাল মজুমদার, স্যার এ এফ রাহমান, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সত্যন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের মতো প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান দেশে সামরিক আইন জারি করে ৩০ ডিসেম্বর, শিক্ষা সচিব এস এম শরীফকে সভাপতি করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এটি শরীফ কমিশন নামে খ্যাত। ১৯৫৯ সালের ২৩ আগস্ট কমিশনের রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা দেয়। রিপোর্টটি ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয়। এ কমিশনের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শরীফ কমিশনের উল্লেখযোগ্য সুপারিশ ছিলো : (১) প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৮০% ব্যয়ভার সংগৃহীত হতে হবে ছাত্রছাত্রীদের বেতন থেকে। বাকি ২০% বহন করবে মন্ত্রণালয় কর্তৃক শিক্ষা বোর্ড। (২) পাস কোর্স এবং অনার্স কোর্স একই সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। (৩) ষষ্ঠ থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা হয়। (৪) ডিগ্রি বিষয়ে পাস নম্বর হতে হবে ৪০%, দ্বিতীয় বিভাগ পেতে ৬০% নম্বর এবং প্রথম বিভাগ পেতে ৭০% নম্বর উঠাতে হবে। (৫) মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হতে হলে যে বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি হতে ইচ্ছুক, সে বিষয়ে ৬০% নম্বর থাকতে হবে। (৬) প্রতি সেশন বা বছর সমাপ্তির কেন্দ্রীয়ভাবে একটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। (৭) অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে উক্ত ছাত্রছাত্রীরা অনার্স কোর্স চালিয়ে যেতে পারবে কি না? নাকি তাদের পাস কোর্সে স্থানান্তর করা হবে। এসব আপত্তিকর রিপোর্ট শরীফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে উপস্থাপিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। ফলে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ থেকে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। শিক্ষা নীতিকে কেন্দ্র করে এর আগে এত বিশাল আন্দোলন অতীতে কখনো হয়নি। এ আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ, ৮৪টি বিভাগ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্র, ছাত্রদের জন্য ২০টি এবং ছাত্রীদের জন্য ৩টি আবাসিক হল, ৭টি স্নাতক পর্যায়ের অধিভুক্ত সরকারি কলেজসহ ১০৫টি অধিভুক্ত কলেজ এবং শিক্ষক ১৯৯২ জন ও শিক্ষার্থী ৩৭ হাজার ১৮ জন। এছাড়া রয়েছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার। আজ তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে দাঁড়িয়ে স্মরণ করছি এর প্রতিষ্ঠাকালীন যুগনায়কদের, বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, যার ঐকান্তিক চেষ্টা ও দানে আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, বক্তৃতা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ঢাকা
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১