আপডেট : ১৪ July ২০২১
প্রকৃতির সন্তানদের মধ্যে অন্যতম এক হিংস্র প্রজাতির নাম হচ্ছে সাপ। জীবনরক্ষার খাতিরে এরা হিংস্র রূপ ধারণ করলেও এ প্রাণীটি (সরীসৃপ) আসলেই বোকাসোকা টাইপের। বলা যায় অনুগতও। বোকা এবং অনুগত যদি না-ই হতো, তাহলে আর বাঁশি বাজিয়ে সাপখেলা দেখানো যেত না। সাপ খেলার বিষয়টি যদিও ধোঁকাবাজি, তথাপিও সত্যি কথাটি হচ্ছে, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মতো সাপের কোনো শ্রবণেন্দ্রিয় সংক্রান্ত শারীরিক গঠন নেই, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘কলামেলা অরিস’ নামে হাড়যুক্ত ডান্ডা রয়েছে। ওই হাড়টি ‘ফেনেস্ট্রা ওভালিস’ থেকে ‘কুয়াড্রাটা হাড় পর্যন্ত বিস্তৃত। এই হাড়ের আবার একটি বিশেষ শারীরিক গঠনপ্রণালি রয়েছে, যাতে করে সাপ ভূমির স্পন্দন ধরতে পারে। তবে হাওয়াই সুর ধরতে পারে না। সেক্ষেত্রে সাপুড়েরা প্রথমে বাঁশির গোড়া দিয়ে সাপকে খোঁচা দিয়ে উত্তেজিত করে নেয়। ফলে সাপ রেগে গিয়ে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। আর সেটিকে তথাকথিত সাপ খেলা হিসেবে চালিয়ে দেয় সাপুড়েরা। সাপ বোকা কিসিমের না হলে এ কাজটি করা বেশ দুরূহ হতো এবং সহজে পাকড়ানোও যেত না। যতদূর জানা যায়, সাপ আক্রান্ত না হলে সহজে কাউকে আক্রমণ করে না। সাপের বিষে যেমন জীবনাবসান ঘটে, তেমনি জীবনধারণও করে। আবার কিছু সাপ যেমন মানবশিশুকে গিলে ফেলে, তেমনি জাতিভেদে কিছু মানুষও আয়েশ করে সাপ খায়। যেমন— চীনসহ এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশে সাপ একটি জনপ্রিয় খাবার। সাপ শুধু প্রকৃতির ভারসাম্যই রক্ষা করে না, এর বিষ মানুষের নানা রোগ থেকে মুক্তি এনে দেয়। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় সাপের বিষের ওষুধ অতুলনীয়। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ‘ক্রোটেলাস হরিডাস’ নামক এক ধরনের স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে তোলার ওষুধ রয়েছে, যা র্যাটেল সাপের বিষ দিয়ে তৈরি। আরো আছে ‘ল্যাকেসিস’ নামক এক ধরনের ওষুধ, যা খেলে প্রচণ্ড মানসিক রোগীও নিরাময় লাভ করে। এ ওষুধটিও তৈরি হচ্ছে বিষধর সাপের বিষ থেকে। সাপটির নামানুসারেই ওষুধটির নাম রাখা হয়েছে ‘ল্যাকেসিস’। এই সাপ যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গলে বাস করে। এতে প্রতীয়মান হয়, সাপ অপকার করলেও আমাদের উপকারী বন্ধু ওরা। অথচ সেই সাপ দেখলেই পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, জাতিভেদে সাপ খাচ্ছেও। আবার সাপুড়ে সম্প্রদায়ের লোকেরাও অবাধে সাপ শিকার করছে খেলা দেখিয়ে কামাই রোজগার করার জন্য। কোনো ধরনের আইনের তোয়াক্কা না করেই তারা যখন-তখন যে কোনো স্থান থেকে বিষধর সাপ শিকার করে নিছক খেলা দেখিয়ে, তাবিজ-কবজ বিক্রি করে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে নিচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, প্রকাশ্যে দিবালোকে সাপ বিকিকিনির হাট-বাজারেও বসছেন তারা। তেমনি একটি বাজার রয়েছে সাভার উপজেলায়। এছাড়াও দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েক স্থানে সাপ বেচাকেনা হয় প্রকাশ্যে। বিষয়টি এমনি পর্যায়ে পৌঁছেছে, মনে হচ্ছে সাপ শিকার এবং খেলা দেখানো বৈধতার মধ্যেই পড়ে। প্রশাসনও এ ব্যাপারে উদাসীন; সাপুড়েদের কখনো আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করে না। অথচ আমরা দেখছি অন্যান্য বন্যপ্রাণী রক্ষার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও আইনের প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন। যেমন, আমরা দেখছি রাজধানীর কাঁটাবন, কাপ্তান বাজারসহ অন্যান্য জায়গায় দেশি বন্যপ্রাণীদের অবমুক্ত করার জন্য দোকানে দোকানে হানা দিচ্ছেন। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ এটি। এই উদ্যোগটি সাপ শিকারের ক্ষেত্রেও নেওয়া উচিত বলে মনে করছি আমরা। কারণ অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের মতো সাপও আমাদের দেশজ মূল্যবান সম্পদের মধ্যে একটি প্রজাতি। তাই সাপের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দিতে হবে প্রশাসনকেই। তাতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি সাপ প্রজাতি রক্ষা পাবে। সে চিন্তা মাথায় এনে সিরিয়াসভাবে দায়িত্ব পালন করলে সাপুড়েরা প্রকাশ্যে দিবালোকে অমন জঘন্য কাজ করতে সাহস পেতেন না আর। আমরা জানি, সুন্দরবনাঞ্চলে সাপ শিকার এবং দেশের সর্বত্র অজগর সাপ শিকারের ব্যাপারে কিছু বাধা-নিষেধ থাকলেও সাপুড়েরা তার কোনো তোয়াক্কা করছেন না, বরং সাপুড়েরা আমজনতাকে বিভিন্ন কায়দায় ভয় দেখাচ্ছেন। সর্বসাধারণও সাপুড়েদের প্রতিহত করার সাহস পাচ্ছেন না তাই, ওদের বেশভূষা আর সাপখোপ সঙ্গে থাকায় মানুষ দূরে থাকার চেষ্টা করে। সাধারণের ধারণা, সাপুড়েরা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠলে বিপদ আছে। তাবিজ-কবজ দ্বারা মানুষের অনিষ্ট করার সক্ষমতা ওদের রয়েছে। আবার অনেকের ধারণা, সাপুড়েদের উত্ত্যক্ত করলে তারা নিরাপদে থাকতে পারবে না। রাতের অন্ধকারে অথবা সুযোগে প্রতিহতকারীর ঘরে সাপ ছেড়ে দেবে। বিষয়টা একেবারে মিথ্যেও নয়। সাপুড়েরা ভয়-ডর দেখাতে এ ধরনের কাজ করেনও। এমন সংবাদ আমরা গণমাধ্যম মারফত জানতেও পেরেছি। বিশেষ করে ভারতের সরকারি অফিসে সাপ ছেড়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও আমরা জানতে পেরেছি। আমাদের দেশেও এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে সাপুড়েরা। সরকারি অফিসে সাপ না ছাড়লেও মানুষের বাসাবাড়িতে সাপ ছেড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করার ঘটনা জেনেছি। এ ধরনের আতঙ্ক সবসময় সৃষ্টি করার প্রয়োজন হয় না। কোনো একসময় কেউ আতঙ্ক সৃষ্টি করলেই সেটি পরবর্তীকালে যুগ যুগ ধরে উদাহরণ হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মুখে মুখে তা প্রচার করতে থাকেন। যার ফলে দেখা যায়, অন্যান্য বন্যপ্রাণী নিধনের ক্ষেত্রে মানুষ কিছুটা প্রতিবাদ করলেও সাপ শিকারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের উচ্চবাচ্য করেন না। তার আরেকটি কারণও আছে, সাপ মানুষের কাছে যুগ যুগ ধরে শত্রু হিসেবে গণ্য হয়ে থাকার কারণটিও এর মধ্যে অন্যতম। জানা গেছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৬০ হাজার লোক সর্প দংশনের শিকার হয়। যার চিকিৎসা পর্যাপ্ত নেই, চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি দেশে সহজলভ্য হতো, তাহলেও মানুষের কাছে সাপ ততটা হিংস্র হয়ে উঠত না। যার ফলে সাপ নিধনের ক্ষেত্রে মানুষ আফসোস করার চেয়ে বরং খুশিই হয় বেশি। পারলে সাপুড়েকে ডেকে এনে নিজের ঘরদোর পরীক্ষা করিয়ে নেয় সাপের আনাগোনা রয়েছে কি-না তা জানতে। শহরঞ্চলে সাপ আতঙ্কের কারণ না হলেও অজপাড়াগাঁয়ে সাপ আতঙ্কের কারণই বটে। বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চল এবং চরাঞ্চলের জীবনযাত্রায় সাপ মানুষের কাছে বিভীষিকাময় আতঙ্ক। যাদের মাটির মেঝে, তারা সাপের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠেন। তারা সাপুড়ের দ্বারস্থ হয়ে তাবিজ-কবজ এনে ঘরে লটকিয়ে রাখেন। এই কুসংস্কারটা আমাদের দেশে যুগের পর যুগ রয়ে গেছে। অথচ এর থেকে পরিত্রাণের সহজ উপায় হচ্ছে কার্বলিক এসিডের ব্যবহার। বিষয়টি আগে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে অবগত করতে পারলে এবং কার্বলিক এসিডের ব্যবহারবিধি জানিয়ে দিতে পারলে মানুষ আর সাপের মধ্যকার শত্রুতা অনেকটাই দূর করা যেত। বিশেষ করে সাপ নিধনের বিষয়ে আগে সোচ্চার হতে হবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে, তবেই সাপ বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পাবে আমাদের দেশে। পাশাপাশি সাপের বিষ ওষুধ শিল্পে ব্যবহারের মাধ্যমে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও সুযোগ হবে। উল্লেখ্য, আমাদের দেশের তরুণদের কেউ কেউ সাপের খামার করে স্বাবলম্বী হওয়ারও চেষ্টা করছেন। তাদের নিরুৎসাহিত না করে বরং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তোলার উদ্যোগ নিলে কিছুটা হলেও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। তাতে সাপুড়েদের দৌরাত্ম্যের পাশাপাশি সাপ নিধন অনেকটাই কমে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস। মানুষকে যদি একবার বুঝিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে, শুধু সাপুড়েরাই নয়, সাধারণ মানুষও সাপকে বশে আনতে পারে তাহলে বোধকরি সাপ নিধন পঞ্চাশ শতাংশ কমে যাবে। সাপ নিধন আরো কমে যাবে যদি নির্বিষ সাপ মানুষকে চিনিয়ে দেওয়া যায়; বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে, দেশের ৮০ শতাংশ সাপ নির্বিষ। আর বাণিজ্যিকভাবে সাপের খামারের সফলতা তুলে ধরতে পারলে তো কথাই নেই, তরুণরা সেদিকেই ঝুঁকবে। কারণ দেশের তরুণদের মধ্যে এখন উদ্যোগী হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কর্মসংস্থানের বিষয় টের পেলেই সে ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতাও লক্ষ করছি আমরা। এক্ষেত্রে আমাদের বন্যপ্রাণী অধিদপ্তর এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সচেষ্ট হলেই বোধকরি সাপ প্রজাতি রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি সাপ প্রজাতির মাধ্যমে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রও তৈরি হবে। লেখক : কথাসাহিত্যিক ও বন্যপ্রাণীবিষয়ক লেখক
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১