আপডেট : ০৮ July ২০২১
শফিকুল ইসলাম খোকন স্থানীয় সরকার নিয়ে সকল মহলে একটি বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে, স্থানীয় সরকার মানেই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। এই অপপ্রচারের কারণে জনগণও মনে করে, চেয়ারম্যান-মেম্বাররা গম-চাল চুরিতে জড়িত। মন্ত্রী-এমপিসহ সরকারের আমলারাও একই মানসিকতা ধারণ করেন। গত ৯ জুন ঢাকায় আয়োজিত ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে নিরীক্ষার জন্য নিয়োজিত অডিটরদের প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যদি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে ক্ষমতায়ন করে জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতার আওতায় আনতে পারি এবং আয়বর্ধক হিসেবে গড়ে তুলে আত্মনির্ভরশীলতার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে দেশের উন্নয়নের জন্য সহযোগী দেশ কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে লোন নিতে হবে না (সারাবাংলা, ৯ জুন ২০২১)।’ এখানে স্থানীয় সরকারের জন্য বাজেটে কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪২ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা (সম্পূরক ব্যয়সহ) বরাদ্দ ছিল। ধরে নেওয়া যাক তার ১০ ভাগ অর্থ, তথা ৪ হাজার ২শ কোটি টাকা মোট ৪৫৭১টি ইউনিয়নে ব্যয় হয়েছে। আর প্রশান্ত হালদার ওরফে পিকে হালদার একাই চারটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে (এনবিএফআই) ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। ২০১২ সালে হলমার্ক ৩ হাজার ৫শ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। সেইসঙ্গে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতি তো রয়েছেই। এর আগে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি বলেছে, বাণিজ্যে কারসাজির মাধ্যমে এদেশ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। টিআইবি বলেছে, প্রতি বছর পাচার হয় ১ লাখ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয় তা দিয়ে চারটি করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। এখন প্রশ্ন করা যায়, এসব দুর্নীতির সঙ্গে কি স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা জড়িত? মন্ত্রীর এ মন্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে যদি কোনো বিরোধীদলীয় এমপি বলেন, ‘আমরা যদি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার আওতায় আনতে পারি, তাহলে দেশটি আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পাশাপাশি দাতা দেশের তালিকায় চলে যাবে।’ তাকে কি কেউ ভুল বলবেন? উল্লেখ্য, ২০২০ সালে সিরাজগঞ্জ জেলায় এক পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে এলজিএসপি (লোকাল গভর্নমেন্ট সাপোর্ট প্রোগ্রাম) শুরু হয়। শুরুতে বলা হয়, সংবিধানের অঙ্গীকার অনুযায়ী প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য শুধু দায়িত্ব প্রদান নয়, তৎসহ ক্ষমতা, আর্থিক স্বাধীনতা এবং পরিষদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রথমে এলজিএসপি-১, তারপর এলজিএসপি-২ এবং বর্তমানে এলজিএসপি-৩ চালু রয়েছে। এলজিএসপি’র তিন কিস্তিতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৭শ কোটি টাকা। এই অর্থের অর্ধাংশ বাংলাদেশ সরকার, বাকি অর্ধাংশ বিশ্বব্যাংক বহন করছে। অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক জড়িত থাকায় এ অর্থ তদারকির জন্য সচিবালয় থেকে শুরু করে জেলা পর্যন্ত চার/পাঁচজন কর্মকর্তা রয়েছেন। সেইসঙ্গে কনসালট্যান্সি কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। তাদের বেতন-ভাতাও বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংক যৌথভাবে বহন করছে। এলজিএসপি’র বরাদ্দকৃত অর্থ দ্বারা গৃহীত প্রকল্পসমূহ যেন সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হয় সেজন্য প্রতি বছর ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে অডিট টিম নিরীক্ষা করে থাকে। সরকারি অডিটরদের প্রতি বিশ্বব্যাংকের আস্থা না থাকায় টেন্ডারের মাধ্যমে বাছাইকৃত অডিট ফার্ম দ্বারা নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। অডিটররা প্রতি ইউনিয়নে ৩ থেকে ৭ দিনব্যাপী সুঁই খোঁজার মতো কাগজপত্র পরীক্ষা করে থাকে। ফলে বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদগুলো এলজিএসপি’র গৃহীত প্রকল্পের সঙ্গে অন্যান্য প্রকল্পেও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হচ্ছে। বর্তমানে ইউনিয়নগুলোতে জনসংখ্যার প্রায় ৬০ ভাগ ইউনিয়ন তথা গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করছে। বাকি ৪০ ভাগ পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবাস করছে। কিন্তু স্থানীয় সরকারের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের প্রায় ৭০ ভাগ অর্থ ব্যয় করা হয় নগরীয় ইউনিটগুলোতে। শোনা যাচ্ছে, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোতে স্বচ্ছতা আনার জন্য সেখানেও এলজিএসপি’র প্রকল্প চালু করা হবে। এলজিএসপি’র শুরুতে বলা হয়, ইউনিয়ন পরিষদগুলো যেন স্বাধীনভাবে চলতে পারে এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যেন জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় সে লক্ষ্যেই এলজিএসপি’র প্রকল্প নেওয়া। কিন্তু বাস্তবে ঘোষণার সঙ্গে গৃহীত কার্যক্রমের কোনো মিল নেই। বাইরে থেকে অডিট টিম দেওয়া মানে ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে অবিশ্বাস করা। এ অবিশ্বাস থেকে ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে বহু কর্তৃপক্ষ তত্ত্বাবধান করে থাকে। যেমন, ইউএনও, ডিডিএলজি, ডিসি, বিভাগীয় কমিশনার, সব শেষে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। আমরা জানি দায়িত্ব দেওয়া ছাড়া কেউ দায়িত্ববান হয় না। সেই দায়িত্ব অবশ্যই এককভাবে সম্পন্ন করার ক্ষমতা দিতে হয়। প্রায় ১৫০ বছর আগে স্থানীয় সরকারের জন্ম ঘটে। কিন্তু প্রতিটি সরকার স্থানীয় সরকারকে ব্যবহার তথা অধীনস্থ করে রাখায় স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা নিজেরা স্বাধীনভাবে চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এ প্রসঙ্গে বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সেখানে যাই ঘটুক তাদের বিশ্বাস করতে হবে।’ আমরা জানি প্রেস ক্লাব, ব্যবসায়ী সমিতি, বিভিন্ন সমবায় সমিতি নিজেরাই নিজেদের কার্যক্রমের অডিট করে থাকে। তাহলে স্থানীয় সরকারগুলো নিজেদের অডিট নিজেরা কেন করতে পারবে না! ঢাকা সেগুনবাগিচায় বিশাল এলাকাজুড়ে মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় রয়েছে। মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের অধীনে দুই হাজার কর্মকর্তাসহ প্রায় ৮ হাজার অডিরটর কাজ করে থাকেন। সরকারের এত বিপুল সংখ্যক অডিটর থাকতে অডিটর ভাড়া করে স্থানীয় সরকারের অডিট করতে হবে কেন? যদি তারা দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে থাকে তাহলে তাদের বেতন দিয়ে পোষার দরকার কী! হয়তো একদিন শোনা যাবে, সরকার বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে সরকারি অডিটরদের অডিট করার জন্য ‘অডিট ফার্ম’ নিযুক্ত করেছে। এটি সত্য যে, স্বাধীন দেশ কখনো পরনির্ভর থাকতে পারে না। সেজন্য সরকারের প্রতিটি সেক্টরে স্বচ্ছতা আনার জন্য দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা প্রয়োজন। তাহলো কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজের দায়িত্ব পালন করবে আর সকল স্থানীয় কাজ স্থানীয় সরকারগুলো এককভাবে সম্পন্ন করবে। বর্তমানে একটি মাত্র সরকার থাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ ও অনিয়মগুলো জনগণের কাছে সেভাবে দৃশ্যমান নয়; কিন্তু বাড়ির কাছের স্থানীয় সরকারের কাজগুলো দৃশ্যমান থাকায় সকলে স্থানীয় সরকারের সামান্য অনিয়মকেই বড় দুর্নীতি হিসেবে দেখে থাকে। সেজন্য প্রতিটি কাজের দায়িত্ব-কর্তব্য নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট করে দিতে হবে। দুর্নীতি হয় উপযুক্ত ম্যাকানিজমের অভাবে ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে। সকলের সেদিকেও লক্ষ রাখা উচিত। লেখক : স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক msi.khokonp@gmail.com
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১