বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০৪ July ২০২১

প্রতিবন্ধকতা জয়ী রাজন


মো. রাজন হোসাইনের বাসা ঢাকার উত্তরখানের দোবাদিয়ায়। তার বাবার নাম হাজী মো. সামসুল হক। মা পিয়ারা খাতুন। রাজনরা দুই ভাই এক বোন। তার মধ্যে সেই সবার ছোট। রাজনের যখন এক থেকে দেড় বছর বয়স তার জ্বর হয়। তখন তার বুক থেকে সারা শরীর অবশ হয়ে যায়। রাজন হাতে পায়ে শক্তি পেতেন না। কথা বললে কিংবা কাঁদলে তার কোনো আওয়াজ বের হতো না। কোনো অনুভূতি ছিল না। ক্ষিধে লাগলে শুধু কান্না করতেন। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লে বাবা-মা বুঝে নিতেন যে, তার ক্ষিধা পেয়েছে। পরে বিভিন্ন ডাক্তার, কবিরাজ দেখানো হয়। তাদের পরামর্শমতো ঘরেই তার বাবা-মা তাকে থেরাপি দিতেন, তেল গরম করে হাত পা মালিশ করতেন। ধীরে ধীরে কোমর থেকে শরীরের উপরের অংশে অনুভূতি ফিরতে শুরু করে এবং কথা বলতে শুরু করেন রাজন। তখন  তার আওয়াজ সবাই শুনতে পারত। রাজন তখন হামাগুড়ি দিয়ে চলা শুরু করেন। হামাগুড়ি দিয়ে চলার সময় রাজনের হাত-পা ছিলে যেত।

যখন রাজনের বয়স ৩ থেকে ৪ বছর, তখন বাসার বারান্দায় হাঁটার জন্য বাঁশ বেঁধে দেওয়া হয়। এভাবে রাজনের হাঁটার প্র্যাকটিস শুরু হয়। ডাক্তারের পরামর্শে তাকে ক্র্যাচ কিনে দেওয়া হয়। তখন রাজন চলাচলের জন্য ক্র্যাচ ব্যবহার করতে শুরু করেন। কিন্তু, তারপরেও সে কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত পূর্ণ শক্তি পাইনি। তার পা অনেক চিকন। চলাচল করার ক্ষেত্রে ক্র্যাচ ছাড়া বা কোনো সাপোর্ট ছাড়া চলতে এখন সে চলতে পারেনা।

ক্র্যাচ ভর করে হাঁটতে শেখার পর রাজন ভর্তি হলেন মা আমেনা আদর্শ কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে। সেখানে প্রথম শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেন। পরে ভর্তি হন সিভিল এভিয়েশন হাই স্কুলে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ইন্টারে আনোয়ার মডেল ডিগ্রি কলেজের কমার্স বিভাগে ভর্তি হন।

রাজনের স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে চার্টার্ড একাউন্টেট হবেন। ইন্টার শেষে অনেক স্বপ্ন নিয়েই ২০০৬ সালে ভর্তি হলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের একাউন্টিং-এ। ক্লাস শুরুর পর থেকেই রাজন তার কয়েকজন বন্ধুর সাথেই সবসময় কলেজে আসা যাওয়া করতেন। একদিন বিশেষ এক কারণে বন্ধুদের ছাড়াই একা ফিরে আসতে হয়েছিল বাসায়। সেদিন কলেজ থেকে বাসায় আসার জন্য বাসে উঠতে গেলে পা পিছলে পড়ে যান বাস থেকে। গুরুতর আহত হন। ফলে তাকে কয়েকদিন রেস্টে থাকতে হয়। ক্লাস করা অসাধ্য হয়ে গিয়েছিল তার পক্ষে। তখন পরিবারের সবাই তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তারা শঙ্কিত হয়ে পড়েন যে, এভাবে একা একা যাতায়াত ছেলেটির পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু অন্যদিকে কলেজের ক্লাস না করলেই নয়। কারণ, ক্লাসে উপস্থিতির জন্য ছিল ২৫ নম্বর। আরো ভালো রেজাল্ট করার জন্য ওই ২৫ নম্বর ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাসায় সবাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন, এ সমস্যার কথা তারা স্যারকে জানাবেন। রাজন ও তার মামা স্যারের সাথে দেখা করেন এবং স্যারকে অনুরোধ করেন, তাকে সপ্তাহে যে কোনো ৩ দিন ক্লাস করার অনুমতি যেনো দেওয়া হয়। আর বাকি যেই কয়দিন তিনি যেতে পারবেন না তার জন্য যেনো ক্লাস এটেন্ডেন্সের মার্কটা না কাটা হয়। স্যার জানিয়ে দেন এভাবে সম্ভব না। প্রতিদিন ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে মার্ক দেওয়া যাবে না। স্যারের কথা শুনে মনটা ভেঙ্গে গেল রাজনের। ফলে শিক্ষাজীবনের ইতি ওখানেই টানতে হয়। রাজন মাত্র ৬ মাস ক্লাস করতে পেরেছিলাম তিতুমীর কলেজে।

ঘরে বসে থেকে তখন অনেক কিছুই মনে হত রাজনের। নিজের স্বপ্নের সাথে নিজেই লড়াই করতেন। নিজেকে ফিরে পেতে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াতেই বাসার কাছেই ছাত্র পড়ানো শুরু করেন। সে সময় বড় ভাইয়ের পরামর্শে ও সহায়তায় বাসার কাছের বাজারে একটি ছোট স্ট্যাশনারির দোকান দেন রাজন। কিন্তু, ধারদেনার জন্য একটা সময় দোকানটা ছেড়ে দিতে হয়।

তারপর ২০০৮ সালে যুক্ত হন আবদুস সাত্তার দুলাল স্যারের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠা ঢাকা ডিপিওডিতে। সেখানে মূলত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কল্যাণার্থে ও স্বাবলম্বী করতে বিভিন্ন কর্মশালা, আর্থিক অনুদান ও বিভিন সহায়ক উপকরণ প্রদান করা হতো। রাজন সেই সংগঠনের নির্বাচিত সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। পরবর্তী সংগঠনটির সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন।

তারপর ২০১৭ সালে ডিপিওডির সদস্য আলাউদ্দিন আউয়াল (স্ট্যান্ডিং-শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটের দলের খেলোয়াড়) রাজনকে মহসীন-নাহিয়ানের নেতৃত্ব গড়ে উঠা হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলের বিষয়ে জানান। পরে রাজন মহসীন ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাহিয়ানের নেতৃত্বে হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলের প্র্যাকটিস সেশন শুরু হয়েছে। রাজনকে  যেতে বললেন মহসীন। রাজনও যুক্ত হলেন প্র্যাকটিস দলের সাথে। প্র্যাকটিস শেষে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের জন্য দল ঘোষণা হয়। সেই দলে অলরাউন্ডার হিসেবে সুযোগ পান রাজন। স্বপ্ন পূরণের আর এক ধাপ এগিয়ে যান তিনি।

তারপর রাজন ঢাকাতে অনুষ্ঠিত ভারতের হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলের সাথে আয়োজিত প্রথম টি-২০ ক্রিকেট সিরিজে অংশগ্রহণ করেন। তিনটি ম্যাচেই সুযোগ পান বাংলাদেশের হয়ে খেলবার। সিরিজটিতে বাংলাদেশ ভারতের বিপক্ষে ২-১ এ জয়লাভ করেন। এই ২-১ এ জয়লাভের পেছনের অন্যতম কারিগর ছিলেন রাজন। প্রথম দুই ম্যাচে ১-১ এ সমতা ছিল। আর শেষ ম্যাচে জয় লাভ করতে বাংলাদেশ দলের প্রয়োজন ছিল ১ বলে ২ রান। ব্যাটিং প্রান্তে ছিলেন রাজন। যে করেই হোক ২ রান নিতেই হবে। দলকে জিতাতে হবে। দেশের সম্মান তখন রাজনের হাতে। নিমিষেই চারপাশ দেখে নিতে নিতে বোলার ছুটে বল ডেলিভারি করল। রাজন সজোরে এক হাতে ব্যাট চালালো। আর বল গিয়ে পড়ল বাউন্ডারির ওপারে। আম্পায়ার হাত তুলে নির্দেশ দিলেন ৬। আর গ্যালারি থেকে দর্শক ও টিমমেটরা সবাই রাজনের দিকে ছুটে আসতে শুরু করলেন । একে একে সবাই তাকে জড়িয়ে ধরলেন। সবার চোখে তখন আনন্দের অশ্রু। রাজনের জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি। সেখান থেকে তার জীবনের নতুন আরেকটি অধ্যায় শুরু হলো। নতুন পরিচয় তৈরি হলো ক্রিকেটার হিসেবে।

২০১৭ এর ডিসেম্বরে হুইলচেয়ার ক্রিকেটের দলের নেপাল ট্যুর ছিল। ট্যুর থেকে ফিরে এসে নূর নাহিয়ান (হুইলচেয়ার ক্রিকেট টিমের কো-ফাউন্ডার ও ভাইস ক্যাপ্টেন) রাজনের সাথে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্পোর্টস নিয়ে নতুন একটা পরিকল্পনা শেয়ার করলেন। নাহিয়ান ভাই বাংলাদেশ হুইলচেয়ার স্পোর্টস ফাউন্ডেশনের প্ল্যানিংটা জানালেন। শুরু হলো তাদের নতুন স্বপ্নের কাজ। ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল নাহিয়ানের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হলো বাংলাদেশ হুইলচেয়ার স্পোর্টস ফাউন্ডেশনের। এরপর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা আনুষ্ঠিকভাবে তাদের যাত্রার শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। বর্তমানে করোনার থাবায় থমকে আছে তাদের কার্যক্রম। তবুও, অনলাইনে রাজনরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য হলো, বিশ্ব প্যারালিম্পিকের মঞ্চে যেন এই ফাউন্ডেশনের ক্রীড়াবিদরা বাংলাদেশের হয়ে অংশগ্রহণ করতে পারে তার জন্য তাদের ক্রীড়াক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি ও পেশা হিসেবে যেন খেলাধুলাকে নিতে পারে তা নিয়ে কাজ করা।

২০১৮ সালে রাজন বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে জাপানের নাগোয়ায় গিয়েছিলেন হুইলচেয়ার ম্যারাথনে অংশগ্রহণ করতে। বর্তমানে রাজন বাংলাদেশ হুইলচেয়ার স্পোর্টস ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং ওয়ার্ল্ড প্যারা ডার্টসের বাংলাদেশের সমন্বয়ক হিসেবে যুক্ত আছেন।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১