আপডেট : ০১ July ২০২১
বিশাল সাহা ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’-রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লার রচিত কালজয়ী এই গান সবার প্রিয় হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই কথা যেন কেউ বলতে পারছে না। বলতে গেলেই কেঁপে উঠছে বুক। বুকের ভেতর আততায়ী চিৎকার যেন সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। করোনার প্রাদুর্ভাবে মানুষের মনে ভয়-ভীতি কাজ করছে সবসময়। সহ্যের সীমা অতিক্রম করতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ দিনকে দিন করোনার জন্য। করোনা অতিমারী বাংলাদেশে হানা দেওয়ার বছর পার করেছে গত মার্চ মাসের ৭ তারিখে। করোনা হানা দেওয়ার শুরুর দিক থেকেই সরকার জনগণের স্বাস্থ্য সচেতনতার দিকে জোড় দিয়েছিলেন। আক্রান্ত, মৃত্যু ঠেকাতে দেশজুড়ে কয়েক দফায় লকডাউন ঘোষণা করেছিল সরকার। প্রথম দিকে জনগণ লকডাউন ভালোভাবে মানলেও জীবিকার তাগিদে ধীরে ধীরে লকডাউন অমান্য করতে বাধ্য হয় সবাই। কেননা লকডাউন যে নীরব দুর্ভিক্ষের ডাক দিয়ে যায়। দুর্ভিক্ষ বলার কারণ হলো, একে করোনার প্রাদুর্ভাবে ভয়-ভীতিতে দিন অতিবাহিত করতে হতো, এমনকি এখনো করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের, তার ওপর লকডাউন যেন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায়। করোনার বিস্তার যেন আলোর গতিতে বাড়ছে। করোনা দেশে আসার প্রথমদিকে প্রকট হলেও মাস ছয়েক পর থেকে কিছুটা দুর্বল হতে থাকে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন দেখে খুব শীঘ্রই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরার। কিন্তু এরপর করোনার কঠিন ও দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশ বিপর্যস্ত হয়ে যায়। শুধু দেশ নয়, বিশ্বের বেশ কিছু দেশের অবস্থা করুণ হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে ভারত উল্লেখযোগ্য। ভারতের রাজধানী দিল্লি নিমিষেই মৃত্যুপুরী হয়ে যায়। প্রতিদিন অগণিত মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়। লাশ দাহ করা কিংবা কবর দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছিল প্রশাসনের। অনেকটা নিরুপায় হয়েই লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। গণদাহ, গণকবরের মতো দৃষ্টিবিদারক অবস্থার সৃষ্টি হয়। ভারতের এহেন অবস্থার পর আমাদের দেশেও করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপ শুরু হয়। একের পর এক বাংলাদেশেও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হতে থাকে। ভয়ানক আতঙ্ক গ্রাস করে নেয় দেশবাসীকে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের আক্রান্ত বন্ধ করতে সরকার দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। বেশ কিছু এলাকা পুনরায় লকডাউন দেওয়া হয়। কিন্তু লকডাউনের নামে যেন প্রহসন চলছিল দেশে। স্বাভাবিক নিয়মে সবকিছু চলছিল। মাস্ক পরিধান কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো ভ্রূক্ষপ নেই। প্রশাসন যেন নীরব দর্শকের দায়িত্ব পালন করে গেছে। মাঝ থেকে শুধু সাধারণ জনগণকে যানবাহনে গাদাগাদি করে গেলেও গুনতে হয়েছে ৬০% বেশি ভাড়া। এরই মধ্যে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আবির্ভাব। দৈনিক আক্রান্তের হার ও মৃত্যুর হার রেকর্ড পাল্টাচ্ছে। ভারতীয় ডেল্টা ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে বিপর্যস্ত জনজীবন। গত ২৪ জুনের সরকারি তথ্যমতে, দেশে গত আড়াই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের সংখ্যা ৬০৫৮ জন আর ২৬ জুন আবারো শতকের রেকর্ড ছুঁয়েছে, এদিন মৃত্যু হয়েছে ১০৮ জনের! করোনা আক্রমণের পর থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৩৯৭৬ জন। এ পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮ লাখ ৭৮ হাজার ৮০৪ জন! যে হারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে মনে হচ্ছে অল্প কিছুদিনের মধ্যে যেন আক্রান্তের সংখ্যা দশ লক্ষ্যে গিয়ে দাঁড়াবে। গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। লকডাউন খ্যাত সেই সাধারণ ছুটি কয়েক দফা বেড়ে কার্যকর থাকে ৬৬ দিন। তবুও সংক্রমণ ঠেকাতে না পেয়ে সরকার বিধিনিষেধ, কঠোর বিধিনিষেধ, লকডাউন, সর্বাত্মক লকডাউন, আঞ্চলিক লকডাউন, কঠোর লকডাউন, বিশেষ লকডাউন ইত্যাদি বিভিন্ন শব্দ প্রয়োগ করে বিভিন্ন অবস্থা জারি করে। কিন্তু করোনা নিয়ন্ত্রণ ঠেকানো সম্ভব হয়নি কোনোভাবে। করোনা সংক্রমণ না কমলেও মানুষের অসহায়ত্ব বেড়েছিল কয়েক গুণ। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অনেকে না খেতে পেয়ে অতিবাহিত করেছে দিনের পর দিন। সরকার অনুদান বরাদ্দ করলেও কিছু অসাধু মানুষের জন্য সবার কাছে পৌঁছায়নি, যে কারণে লকডাউন নীরব দুর্ভিক্ষের স্বাক্ষর বহন করছে এখন। বিশ্ব স্বাস্ত্য সংস্থাও সম্প্রতি সে কথাই ঘোষণা করেছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার বদ্ধপরিকর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পড়া লেখার চলমান গতিতে ছেদ পড়েছে শিক্ষার্থীদের। চাকরির বয়স শেষ হওয়ায় হতাশায় ডুবে যাচ্ছে অনেকেই। তাই সবকিছু বিবেচনা করে, করোনা প্রতিরোধে জাতীয় কারিগরি কমিটির নতুন বিধিনিষেধ আরোপের সুপারিশ মিলেছে। যার নাম শাটডাউন। গত ২৮ জুন থেকে শুরু করার কথা থাকলেও সরকার নানা হিসাবনিকাশ করে আজ থেকে তা শুরু করেছে সর্বাত্মক লকডাউন নামে। সারা দেশে এখন অফিস-আদালত, যানবাহন বন্ধ আছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সবকিছু বন্ধ রাখতে হবে। কিন্তু অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে এই কথিত সর্বাত্মক লকডাউন কতটুকু ফরদায়ক হবে তা অতীতেও আমরা লক্ষ করেছি। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিধিনিষেধ জারি করলেও মাঠ পর্যায়ে তার বাস্তবায়ন চোখে পড়েনি। শুধু চোখে পড়েছে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি। তাই সর্বাত্মক লকডাউন কতটা কার্যকর হবে তা নির্ভর করছে মূলত সরকারের সদিচ্ছার ওপরে। এর শতভাগ বাস্তবায়নে মাঠ প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। যদিও জানি শাটডাউন করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য যৌক্তিক হলেও মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, দিনমজুরদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। তথাপি বৃহত্তর স্বার্থে কিছুদিনের জন্য এটা মেনে নিতে হবে। তবে শাটডাউন কার্যকরের পাশাপাশি কর্মহীন ও ছিন্নমূল মানুষের জন্য সরকারের প্রণোদনা যতখানি সম্ভব চালু রাখা জরুরি। প্রয়োজনে সরকার পুঁজিপতি ব্যবসায়ী, অর্থবিত্তশালীদের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে এটি অব্যাহত রাখবে। উপরন্তু এ-সময় কেউ যেন কর্ম না হারায়, বেতন বকেয়া না থাকে, সে বিষয়টি তদারকির জন্য এক বা একাধিক কমিটি গঠনের মাধ্যমে বেসরকারি অফিস, কলকারখানাগুলো নজরদারি আওতায় আনার অনুরোধ করছি। সাধারণ মানুষ করোনা থেকে মুক্তি চায়, সেইসঙ্গে চায় ভালোভাবে বাঁচতে। শাটডাউনে যেন কোনো অনাহারী না থাকে তা নিশ্চিত করা জরুরি। সেইসঙ্গে জরুরি শাটডাউন বাস্তবায়নে বিভিন্ন পরিকল্পনা। কেননা এবারের সর্বাত্মক লকডাউনও যেন সবার কাছে হাস্যরসাত্মক হয়ে না ওঠে। সর্বোপরি জনগণ চায় নিজে বাঁচতে, দেশকে বাঁচাতে। তাই শাটডাউনে জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে দেশ ও জীবন রক্ষা করুন। লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১