বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ৩০ June ২০২১

বিপাকে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য


বর্তমানে তিনটি ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে আটকে থাকা বাংলাদেশি পণ্যবাহী কনটেইনারের সংখ্যা ৩০ হাজার টিইইউ-এর (টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট) বেশি। শিপিং এজেন্ট সূত্রে এমনটি জানা যায়।

এদিকে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আমেরিকার ক্রেতার কাছে নিটওয়্যার আইটেমের একটি চালান রপ্তানি করে চট্টগ্রামভিত্তিক বিএলপি ওয়ার্ম ফ্যাশন। আমেরিকার মাদার ভেসেলে জায়গা না থাকায় চালানটি ২১ দিন সিঙ্গাপুর বন্দরে আটকে ছিল।

চারবার চেষ্টা করেও চালানটি সময়মতো পাঠানো যায়নি। অবশেষে গত ১৯ জুন চালানটি একটি জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। যে সময়ে চালানটি আমেরিকায় পৌঁছানোর কথা ছিল, এখন তার চেয়ে ১৮ দিন পরে পৌঁছাবে। জাহাজের অভাবে মাল পাঠাতে দেরি হওয়ায় রপ্তানিকারকরা এখন সময়মতো টাকা নাও পেতে পারেন। বিএলপি ওয়ার্ম ফ্যাশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেছেন, পোর্ট ক্ল্যাং হয়ে চীন ও কোরিয়া থেকে আসা আমেরিকা ও ইউরোপ রুটের সবগুলো মাদার ভেসেল এখন মালবোঝাই থাকে। সে কারণেই তারা পূর্বনির্ধারিত জাহাজে তাদের চালান তুলতে পারেননি।

তিনি আরো বলেন, চালান এখনো যায়নি বলে আমেরিকান ক্রেতার কাছ থেকে এখনো টাকা পাইনি আমরা। এছাড়া চালানে দেরি হওয়ায় আমাদের বড় লোকসান হচ্ছে।

বিএলপি ওয়ার্ম ফ্যাশন লিমিটেডের মতোই আরো অনেক বাংলাদেশি রপ্তানিকারক এখন হন্যে হয়ে জাহাজের খোঁজ করছেন। মালয়েশিয়ার পোর্ট ক্ল্যাংসহ সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কার কলম্বো-সর্বত্রই এখন জাহাজের অভাব।

টানা কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর বিশ্ববাজার ফের চালু হওয়ায় পণ্যের চাহিদা বেড়ে গেছে। এর ফলেই এই জাহাজসংকট বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া বন্দর থেকে পণ্য বহনে জাহাজগুলোর ধীরগতি এবং কোভিডে সংক্রমিত হয়ে বন্দরের অনেক কর্মচারী কাজে আসা বন্ধ করে দেওয়াও এ সংকটের অন্যতম কারণ। অন্যদিকে চালান আটকে থাকার ফলে বাংলাদেশি রপ্তানিকারক এবং আমদানিকারকদের কী পরিমাণ লোকসান হয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন রুট, বিশেষ করে এশিয়া থেকে আমেরিকা রুটের চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত স্টিল বাক্স নেই। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপের বাজার আবার খুলে গেলে পণ্যবাহী জাহাজের ওপর চাপ আরো বাড়তে পারে।

জানা যায়, শিপিং লাইনগুলো তাদের সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করছে। কয়েক হাজার নতুন কন্টেইনার অর্ডার করেছে। সেগুলো ধীরগতিতে আসছে। বন্দরগুলো যদি অতিরিক্ত পণ্যের চাপ সামলাতে না পারে, তাহলে নতুন কন্টেইনার এনেও খুব একটা লাভ হবে না।

বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকায় মাদার ভেসেলগুলো সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে পারে না। সেজন্য বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে জাহাজ বদলাতে হয়।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, শিল্পপণ্যের কাঁচামাল বন্দরে আটকে থাকায় বাংলাদেশি আমদানিকারকরাও লোকসানে পড়েছেন।

কনটেইনার জট, মাদার ভেসেলে জায়গা সংকট এবং শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে ফাঁকা কনটেইনারের অভাবের কারণে আমদানি করা কার্গো কনটেইনারগুলোর চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোও অনিশ্চিত হয়ে গেছে। রহিম টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিন চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, আমার কারখানার কাঁচা তুলার একটা চালান বাড়তি ৩০ দিন কলম্বো বন্দরে আটকে ছিল। যে কনটেইনার এপ্রিলের শেষের দিকে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল, সেগুলো এখন বন্দরের বহির্নোঙরে অপেক্ষা করছে।

শিপিং কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, কলম্বো বন্দরে বিশাল জটের কারণে বাংলাদেশের কনটেইনারগুলো প্রায় ৪৫ দিন ধরে বসে আছে। ফলে সিঙ্গাপুর বন্দর ও মালয়েশিয়ার পোর্ট ক্ল্যাংয়ে চালান পৌছাতে দুই-তিন সপ্তাহ বিলম্ব হচ্ছে।

মেডিটেরেনিয়ান শিপিং কোম্পানির সহকারী মহাব্যবস্থাপক আজমির হোসেন চৌধুরী বলেন, কলম্বো বন্দরে ৪৫ দিনর বেশি দেরি হচ্ছে। অনেক ফিডার অপারেটর মহামারির সময় বড় জাহাজের বদলে ছোট জাহাজ চালিয়েছে। এর ফলে সংকট দেখা দিয়েছে বন্দরে।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি ও প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে আমদানি করা কাঁচামালের অনেকগুলো চালান আটকে থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, চালানে দেরি হলে লিড টাইম বেড়ে যায়। তাই ক্রেতারা দ্রুত ডেলিভারি পাওয়ার জন্য বিমানে পণ্য পরিবহনের দাবি জানায়। এর ফলে বড় ক্ষতির মুখে পড়তে হয় তৈরি পোশাক খাতকে। তানভীর বলেন, মাদার ভেসেলগুলো যেহেতু সরাসরি আমাদের বন্দরে আসতে পারে না, তাই আমাদেরকে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোর উপর নির্ভর করে থাকতে হয়। বর্তমান সংকট বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসাকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, অতিরিক্ত অর্ডারের চাপ থাকায় প্রায় প্রতিটি টেক্সটাইল উদ্যোক্তা এই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। তার ওপরে যখন তাদের অতিরিক্ত কাজের আদেশের চাপ থাকে।

মাদার ভেসেল ও ফিডার ভেসেলের  সংকট তাদের ভোগান্তি বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষ করে পোর্ট ক্ল্যাং, কলম্বো ও সিঙ্গাপুরে পণ্য পরিবহনের খরচ আকাশছোঁয়া হয়ে যাওয়ায় ও বন্দরে জট লেগে যাওয়ায় আরও বেড়েছে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি।

এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, কনটেইনার সংকটের কারণে তাদের কাঁচামালের চালান বিলম্বিত হচ্ছে। এর ফলে মালামাল পরিবহনের খরচও বাড়তে পারে।

২০২০ সালের নভেম্বরে কোভিড মহামারির কারণে কলম্বো বন্দরে শ্রমিকদের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে সেখানে কনটেইনার জট সৃষ্টি হয়। বন্দরের অনেক কর্মচারীর করোনা সংক্রমণ হওয়ায় সংকট আরও তীব্র হয়।

মালয়েশিয়ার একটি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, পোর্ট ক্ল্যাংয়ের মহাব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন কে সুব্রমান্যম বলেছেন যে পোর্ট ক্লাংয়ের ৫০০ কর্মী কোভিড পজিটিভ হওয়ায় বন্দরের কাজকর্ম বাধাগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রতিদিনই সংকট আগের চেয়ে তীব্র হচ্ছে। এর সমাধান কীভাবে করা যায়, তা তারা জানেন না।

মেডিটেরেনিয়ান শিপিং কোম্পানি জানিয়েছে, তাদের ১০ হাজার টিইইউ কনটেইনার আটকে আছে কলম্বোতে। অন্য কোম্পানিগুলোর প্রত্যেকের ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টিইইউ কনটেইনার আমদানিকৃত শিল্প কাঁচামাল বা রপ্তানি করা তৈরি পোশাক পণ্য ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে আটকে রয়েছে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেন বলেন, বিশ্বব্যাপী অনেক ব্যবসা ফের চালু হওয়ার পরে চালানের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এর ফলে কনটেইনারগুলো ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে আটকে রয়েছে। তিনি জানান, এ সংকট কাটতে আরো সময় লাগতে পারে।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১