আপডেট : ২৭ June ২০২১
শেখ সায়মন পারভেজ হিমেল ভূমিকা ছাড়াই প্রথমে বলি, ওমর ফারুকের হত্যাকাণ্ডটি ধর্মীয় অনুভূতির চোখে না দেখে, মানবতার চোখে দেখা অধিকতর শ্রেয়। ইদানীং গণমাধ্যমে নও মুসলিম ওমর ফারুকের হত্যাকাণ্ড নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। আলোচনা-সমালোচনার জন্ম নেওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা মানবতার পরিপ্রেক্ষিতে হত্যাকাণ্ডটি বিবেচনা করলে অন্যতম জঘন্য কাজ, আর যদি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বা ধর্মীয় অনুভূতি থেকে যদি এটাকে বিবেচনা করি তাহলে কোনোক্রমেই হত্যাকাণ্ডটি মেনে নেওয়ার মতো নয়। যাহোক, একেকজনের ব্যক্তিগত অনুভূতি একেক রকম হবে, এটাই স্বাভাবিক। এই অনুভূতি থেকে দূরে সরে সমষ্টিগত স্বার্থে কিছু বলাই উদ্দেশ্য। গণমাধ্যমের পরিপ্রেক্ষিতে যতটা জানি, ওমর ফারুকের বাড়ি বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে। তিনি ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ছিলেন। যেভাবেই হোক তিনি ইসলাম ধর্মে স্থানান্তরিত হয়েছেন পরবর্তীতে। সেইসঙ্গে অস্থায়ী একটি মসজিদে ইমামতিও করতেন। নও মুসলিম ওমর ফারুকের ধর্ম স্থানান্তর কিংবা ধর্ম গ্রহণ, এটা অবশ্যই তার ব্যক্তিগত বিষয়। এটার ওপর হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার কোনো ব্যক্তি বা সমাজ তথা কোনো দেশ বা রাষ্ট্রেরও নেই। একইভাবে এটাও ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে প্রযোজ্য হতো, যদি ওমর ফারুক ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্মে স্থানান্তরিত হতো। তার অর্থ হচ্ছে, ধর্ম স্থানান্তর বা গ্রহণ অবশ্যই এটা ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয়। ওমর ফারুকের হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয় সশস্ত্র স্থানীয় সন্ত্রাসীদের গুলির মাধ্যমে। ওমর ফারুকের হত্যাকাণ্ডটি শুধু ব্যক্তি ওমর ফারুককে বা ধর্মীয় অনুভূতিকে নির্দেশ করে না, বরং এটা সমস্ত পাহাড়ি জনসাধারণদের জীবন নিরাপত্তার মানকে নির্দেশ করে। তার সাথে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার ও নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে, স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর হয়েও খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী একটি গ্রুপ তাকে দীর্ঘদিন ধরে হুমকি দিয়ে আসছিল। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখার ক্যাডাররা জড়িত। এখন প্রশ্ন, স্বাধীন দেশে সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী কতটা শোভা পায়? একই সাথে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনের ব্যর্থতা কতটা প্রকাশ পায়? পাহাড়ি জনপদে সেনাবাহিনী ও পুলিশ মোতায়ন থাকার পরও কেন সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীর এত তাণ্ডব? ওই সন্ত্রাসীরা কি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়া নিরলস সৈনিকের চেয়ে বেশি শক্তিশালী? সশস্ত্র সেনাবাহিনী ও পুলিশ কি তাহলে সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব ঠেকাতে ব্যর্থ? এই প্রশ্নগুলো জনমনে উঁকি দেওয়া স্বাভাবিক। এখন পাহাড়িদের জননিরাপত্তায় আসি। বলে রাখি, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জন সংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। অবশ্যই এটি সরকারের যুগান্তকারী এক সফলতা। অনেকাংশে পাহাড়িদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব হয়েছে, সেইসাথে তাদের অনেক প্রাপ্তি এখনো অধরাই রয়ে গেছে। তিন পার্বত্য জেলার সংঘাত পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে ঠিকই; কিন্তু এত বছর পার হলেও অঞ্চলগুলোতে অস্থিরতা বিরাজ করছে, যা গণমাধ্যম সাক্ষী দেয়। গত বছর বিবিসি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুক্তি স্বাক্ষরকারী পাহাড়িদের একটি সংগঠন জনসংহতি সমিতি অভিযোগ করছে, চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিভিন্ন গোষ্ঠী নানান উদ্দেশ্য নিয়ে সক্রিয় থাকার সুযোগ পাচ্ছে এবং সে কারণে সেখানে অস্থিরতা বাড়ছে। পার্বত্য অঞ্চলে নাগরিক অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীদের অনেকে বলছেন, চাঁদাবাজি এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই আঞ্চলিক দল এবং গোষ্ঠীগুলো বিভক্ত হয়ে পড়ছে এবং সংঘাত হচ্ছে। পাহাড়ি বলে তাদের অন্য চোখে দেখার সুযোগ নেই, বরং একজন মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করা অপর মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। একজন মানুষ হিসেবে মৌলিক অধিকার প্রাপ্যতা ও নিরাপত্তা অবশ্যই মানবিক ন্যায্য অধিকার। ওমর ফারুকের হত্যাকাণ্ডটি গুলি দিয়ে সংঘটিত হয়েছি। অর্থ স্থানীয় সন্ত্রাসীরা যে কতটুকু শক্তিশালী তা বোঝার অপেক্ষা রাখে না। যদি হত্যাকাণ্ডটি চাপাতি বা দেশীয় অস্ত্রের সাহায্যে সংঘটিত হতো, তাহলে বুঝতাম যে সন্ত্রাসী বাহিনী তুলনামূলকভাবে কম শক্তিশালী অস্তিত্বধারী। কিন্তু হত্যাকাণ্ডটি অস্ত্রের গুলির মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। অতএব সেনাবাহিনী ও পুলিশ থাকার পরও নিজেরা আরো সক্রিয় ক্ষমতাবান। এখানে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতা অবশ্যই মেনে নিতে হবে। এখন আসি আরেক ভিন্ন প্রসঙ্গে, একটু অনুভূতিকে কাজে লাগাতে হবে। আমার প্রশ্ন, যারা এই হত্যাকাণ্ডটি ধর্মীয় অনুভূতির চোখে দেখেন এবং হত্যাকাণ্ডটি ইসলাম ধর্মের জন্য প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করেন; তাদের কাছে প্রশ্ন, যদি ওমর ফারুক ইসলাম ধর্ম থেকে ত্রিপুরার খ্রিস্টান ধর্মে স্থানান্তরিত হতো এবং তাকে কোনো মুসলিম কর্তৃক হত্যা করা হলে কি আপনারা বাহ বাহ দিতেন নাকি এখনকার মতো তখনো একই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতেন? মূলত আমি এটাই বলতে চাচ্ছি, ওমর ফারুকের হত্যাকাণ্ডটি ধর্মীয় অনুভূতির চোখে না দেখে, মানবিকতার বা মানবতার অনুভূতির চোখে দেখেন। তবে এটা মানতেই হবে যে, দল-মত-নির্বিশেষে ওমর ফারুকের হত্যাকাণ্ড অবশ্যই জঘন্যতম অমানবিক, যা দেশ ও জাতির জন্য অশনিসংকেত। হত্যাকাণ্ডটি পাহাড়িদের জননিরাপত্তায় শুধু নয় বরং বিশ্বমানবতাকে নাড়িয়ে দেয়। অতএব পাহাড়িদের জননিরাপত্তার স্বার্থে রাষ্ট্র কর্তৃক সেনা ও পুলিশ মোতায়েন বাড়াতে হবে। বিভিন্ন যুগোপযোগী সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ঘন ঘন অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করতে হবে, বিশেষ করে দুর্গম জায়গাগুলোতে। কেননা পত্রিকায় তাৎক্ষণিক ওমর ফারুকের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলে পৌঁছতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ ব্যর্থ হওয়ার কারণ হিসেবে দুর্গম রাস্তার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারের উচিত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সমস্যা সুষ্ঠুভাবে সমাধান করা। তৃণমূল পর্যায়ে এসব সমস্যা নিরূপণ করতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রতিনিধিদের জনসম্পৃক্ততা আরো বাড়াতে হবে। সন্ত্রাসীদের অবৈধ কার্যকলাপ কঠোর হাতে দমন করতে হবে। দুর্গম স্থানে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর আনাগোনা বাড়াতে হবে। দল-মত নির্বিশেষে নিশ্চিত হোক পাহাড়িদের মানবিক অধিকার ও জননিরাপত্তা। আর যেন গণমাধ্যমে দেখতে না হয়, সেই হাসিমাখা ওমর ফারুকের মতো কারো নিষ্ঠুর জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। লেখক : শিক্ষার্থী ,ফার্মেসি বিভাগ মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১