বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১৬ June ২০২১

মেগাসিটি ঢাকাকে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলুন


এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ

আবারো আমাদের রাজধানী ঢাকা বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিস্ট গ্রুপের গবেষণা ও বিশ্লেষণ শাখা ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের নতুন র্যাংকিংয়ে নিচ থেকে চার নম্বর স্থানে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। বিভিন্ন দেশের শহরের ওপর জরিপ চালানো ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭ নম্বরে রয়েছে। নতুন এই জরিপ অনুসারে ২০২১ সালে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড, দ্বিতীয় অবস্থানে জাপানের ওসাকা এবং তৃতীয় স্থান অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড শহরটির। এই তালিকায় একেবারে তলানিতে রয়েছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। এছাড়া ১৩৮তম অবস্থানে পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোরেসবি, ১৩৬তম অবস্থানে আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স, ১৩৫তম অবস্থানে লিবিয়ার ত্রিপোলি ও ১৩৪তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তানের করাচি। সার্বিক ব্যবস্থা ও অবস্থা কতটা খারাপ হলে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্কের কাছাকাছি ঢাকার অবস্থান হয়।

উড়োজাহাজ থেকে যদি ঢাকা শহর দেখা হয়, তবে বিল্ডিং ছাড়া কিছু দেখা যাবে না। এটার মূল কারণ হচ্ছে, অতিরিক্ত মানুষের চাপ। কাজের সন্ধানে মানুষ যেভাবে ঢাকামুখী হয়েছে, যে শহরটাতে ৩০-৪০ লাখ মানুষ থাকার কথা সেখানে দুই-আড়াই কোটি লোক থাকে। তাহলে শহরটির চেহারা তো এরকমই হবে। আন্তর্জাতিক অনেক জরিপে রাজধানী নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন আমরা দেখতে পাই, এখানে বসবাসের মতো অবস্থা নেই। তারপর হচ্ছে যানজটের মতো একটা বড় সমস্যা। এই সমস্যাগুলো দূর করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাই। সরকার অনেকগুলো ফ্লাইওভার করেছে, ইউলুপ করা হয়েছে। কিছু কিছু ইউলুপ এখন জ্যামের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বোঝা যাচ্ছে এগুলো নির্মাণে যথাযথ পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে।

বর্তমানে আবার মেট্রোরেলের কাজ হচ্ছে, হয়তো দ্রুতই কাজ শেষ হবে। ঢাকায় অনেকগুলো ফ্লাইওভার হয়েছে। এগুলো চালু হওয়ার পরও যেন যানজট মুক্ত হচ্ছে না। ঢাকায় এমন সড়ক আছে যেখানে রিকশা নিয়েও প্রবেশ করা যায় না। গাড়ি তো দূরের কথা। এক্ষেত্রে পুরান ঢাকার অবস্থা সবারই জানা। ঢাকার একদিক থেকে অন্যদিকে কোনো কাজে গেলে দিন একটা পুরো শেষ হয়ে যায়। নতুন ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে অবশ্যই সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার আয়তন বাড়ছে। পরিকল্পনা না থাকলে কিছু করা সম্ভব হবে না।

কিন্তু ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করতে হলে শুধু বিল্ডিং করলে হবে না। বিল্ডিং নির্মাণ করতে হবে অবশ্যই রাজউকের দেওয়া প্লান বা নকশা অনুসারে। ভবনের পাশে খালি স্থান না রেখে ইচ্ছামতো ভবন করা যাবে না। বাসযোগ্য নগরী করার জন্য আমাদের আইন ও বিধি-বিধান আছে। এখন দেখতে হবে এগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কি-না। যারা বাড়ি বানান তারা কিন্তু আইন জানেন। অনেকে জেনেও আইন মানেন না। আইন পালন না করলে একটি বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলা কখনোই সম্ভব হবে না। তা বোঝা বা জানার কারো বাকি থাকার কথা নয়।

মুক্ত বাতাস, ভালো রাস্তাঘাট, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং সুপেয় পানি একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কিন্তু নগরবাসী কি এসব মৌলিক সুবিধা পাচ্ছে? ঢাকায় ৬০ শতাংশ নাগরিকের বসবাস বস্তিতে। তাদের জন্য আমরা টেকসই কিছু করতে এখনো পারিনি। ভবিষ্যতে তাদের জন্য কী করতে চাই; সেটিরও কোনো ব্যাখ্যা নেই। বস্তিতে আগুন লাগলে দেখা যায়, পুরো বস্তিই পুড়ে যায়। বস্তি রক্ষা করা যায় না। এতে বস্তির সবার আশ্রয় হয় খোলা আকাশের নিচে। ফায়ার সার্ভিস কিছুই করতে পারে না। বস্তিতে মাদকের ব্যবসা হয়, অসামাজিক কার্যকলাপ ঘটে— এসব অভিযোগ তুলে তাদের উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত রাখা যাবে না। বস্তিবাসীদের জন্য আলাদা চিন্তা করতে হবে। তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হবে। বস্তিবাসীর উন্নয়ন না করলে আমাদের নগরগুলো বাসযোগ্য হবে না। দেশে এরই মধ্যে যেসব বড় বড় শহর হয়ে গেছে, সেসব শহর নিয়ে পরিকল্পনা নেওয়া কঠিন। তবে পূর্বাচলসহ নতুন করে যেসব শহর হতে যাচ্ছে, সেগুলো নিয়ে যে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, তা বাস্তবমুখী কি-না যাচাই করতে হবে। একইসঙ্গে নগর আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন না ঘটলে এসব নতুন সিটিও অকার্যকর হতে সময় লাগবে না।

নগরবাসীর দুটি অন্যতম ভোগান্তি হচ্ছে— রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং জলাবদ্ধতা। অল্প বৃষ্টিতেই ঢাকা শহর ডুবে যায়। আমাদের দেশে বর্ষাকালে রাস্তা খুঁড়ে কাজ করার বিষয়ে সবসময় পত্রপত্রিকা সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। কিন্তু ঘুরে-ফিরে সেই বর্ষাতেই খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি করলে রাস্তা পরিষ্কার করা যায় না। এর কারণে রাস্তায় জমে থাকা বালি বৃষ্টির পানির সাথে ড্রেনে পড়ে ড্রেনের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। যার কারণে পানি সরতে না পেরে তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। ওয়াসার অভ্যন্তরীণ ড্রেনেজ কাঠামো আছে তারপরও পানি যাচ্ছে না। কোথায় যাবে পানিটা? যাবে খালে। কিন্তু খালই তো নেই। ঢাকা শহরে কাগজে-কলমে ৪৩টি খাল আছে। যার মধ্যে উত্তরায় আছে ২৫টা। এগুলো থেকে এখন লাইফ সাপোর্টে ১২-১৩টি খাল আছে। বাকিগুলো হারিয়ে গেছে। খালগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যে কাজ অব্যাহত রয়েছে। বর্জ্য ব্যবহার থেকে সার ও বিদ্যুৎ তৈরির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাসযোগ্য নগর গঠনে এটা খুব জরুরি।

নগরীর রাস্তা যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে সেটি কখনোই বাসযোগ্য হবে না। রাস্তায় চলাচল করতে গিয়ে পথচারীরা সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার স্বীকার হচ্ছে। নিরাপদ নগরী করতে হলে এই বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। ঢাকাকে নারীবান্ধব শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নারীদের জন্য আলাদা বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। নারীদের নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিবন্ধীবান্ধব নগর ও রাত্রিকালীন আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে দুই কোটি নাগরিকের জন্য গণপরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অথচ অর্থনীতির প্রাণখ্যাত এ পরিবহন খাতটি স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো গুরুত্বই পায়নি। আমাদের এখানে যখন কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, সেটি শেষ করতে পারে না। কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) করা হয়েছিল; কিন্তু সেই দিকনির্দেশনা অনুযায়ী কাজ হয়নি। সেটি করতে পারলে ঢাকা শহরের চিত্র হয়তো পাল্টে যেত। আমাদের পরিবহন খাতের তথ্যের অভাব নেই, প্রকল্পেরও অভাব নেই। অথচ ৭৬ শতাংশ নাগরিক গণপরিবহন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছে। ৮৮ শতাংশ দুর্ভোগের শিকার, ৯২ শতাংশ যাত্রীর অভিযোগ অতিরিক্ত ভাড়া, ৯০ শতাংশ যাত্রী জানে না কোথায় অভিযোগ দিতে হয়। বিভিন্ন কোম্পানির যানবাহনের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা চলছে, তা ঢাকা শহরকে খেয়ে ফেলছে। সারা বিশ্বেই ফুটপাতকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা করা হয়। আর আমাদের এখানে ফুটপাত সব দখলে। ফলে যানজট ঢাকাবাসীর নরকযন্ত্রণার আরেক নাম। এই যানজট নিরসনেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।

রাজধানীতে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে। শুধু রমনা পার্কের গাছ দেখে সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। রাস্তার পাশেও বড় বড় গাছ থাকতে হবে। কেউ কেউ রাস্তার পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেঙে পড়ার কথা বলেন। সেটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে পারে। তারপরও গাছ লাগাতে হবে। ঢাকার চারপাশে থাকা চারটি নদীকে বাঁচাতে হবে। হাতিরঝিলের নিয়মিত সংস্কার প্রয়োজন। রমনা পার্ক ও হাতিরঝিলের মতো আরো দুই-একটি প্রকল্প ঢাকা শহরে স্থাপন করতে হবে।

দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ায় দ্রুত নগরায়ণ ঘটছে। উন্নয়নের এই ছোঁয়া কম-বেশি লেগেছে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে। নগরায়ণের ক্ষেত্রে ঢাকাকে নিয়ে কিছুটা পরিকল্পনা থাকলেও অন্য সব এলাকায় যথেষ্ট ঘাটতি আছে। রাজধানীতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য হিসেবে এখনো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি রাজধানী ঢাকাকে। আধুনিক নগরায়ণের জন্য প্রয়োজন আরো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বিদ্যমান আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১