আপডেট : ০৪ June ২০২১
গাছ মানুষের কাছে বন্ধু হিসেবে পরিচিত, পরিচিত ফুসফুস হিসেবেও। গাছের প্রাণ আছে সেটি যেমন প্রমাণিত, তেমনই প্রমাণিত গাছ দিতে জানে, নিতে জানে না। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে গাছের সঙ্গে আমাদের বৈরী আচরণ কেন! কারো সঙ্গে শত্রুতা আছে রাতের আঁধারে গাছ কেটে ফেল। যানবাহন চলাচলের পথে গাছের শিকড়-বাকড় বাধা হয়ে দাঁড়িছে পুরো গাছ কেটে ফেল। আসবাবপত্রের প্রয়োজনে যেখানে একটি গাছ নিধন করলেই যথেষ্ট সেখানে আরো একটি গাছ কেটে ফেল। দূর পাহাড় কিংবা বন-বনানীর গাছ কেটে এনে ইটের ভাটায় ফেল। এ হচ্ছে আমাদের গাছপ্রীতি! যা প্রাত্যহিক ঘটনা। যেখানে একটি গাছ কাটলে তিনটি লাগানোর পরামর্শ দেওয়া আছে, সেখানে সম্পূর্ণ উল্টোটি লক্ষ্য করছি আমরা। ফলে মনে হচ্ছে গাছের প্রতি আমাদের মমতা মুখে মুখেই রয়েছে! তবে সবাই যে অমন তাও কিন্তু নয়। আবার অনেকের ইচ্ছে আছে গাছ লাগানোর, কিন্তু তার জমি নেই। সেই বিষয়টি নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা। তার আগে আমরা গাছ বিতরণের কিছু খণ্ডচিত্র তুলে ধরছি। বর্ষা মৌসুম ঘনিয়ে এলে আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে গাছের চারা বিতরণ করা হয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীর মাঝে। বিতরণ করা হয় গৃহস্থ কিংবা কৃষকদের মাঝেও। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমরা দেখেছি গ্রামাঞ্চলের চেয়ে মফস্বলে বেশি গাছের চারা বিতরণ করা হয়। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। তবে বিতরণ পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা আবশ্যক। বিষয়টি পরিষ্কার করে বলছি। গ্রামাঞ্চল ব্যতীত আমাদের দেশের মফস্বল শহরের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের ভাড়াবাড়িতে থাকতে হয়। এ ছাড়াও যিনি মফস্বলের স্থায়ী বাসিন্দা তার জমিজমাও সীমিত। কারণ গ্রামের তুলনায় মফস্বলের জমির দাম অনেকটাই বেশি বিধায় সেখানকার অধিবাসীদের জমির পরিমাণও কম। ফলে অনেক স্থানীয়দেরও ভাড়াবাড়িতে কাটাতে হয়। এখন কথা হচ্ছে, যে শিক্ষার্থীর বাবা ভাড়াবাড়িতে থাকেন, তাকে যদি স্কুল-কলেজ থেকে একটি গাছের চারা উপহার দেওয়া হয়, সে শিক্ষার্থী কি চারাটিকে ঠিকভাবে সৎকার করতে পারবেন! নিশ্চয়ই না। তাহলে উপহার পাওয়া ওই গাছের চারাটির স্থান কোথায় হবে? বারান্দা অথবা চিলেকোঠার ঘুপচিতে নিশ্চয়ই। অথবা অতিউৎসাহী শিক্ষার্থীরা টবে লাগিয়ে দু’চারদিন পানি ঢেলে পরিশেষে বারান্দায় ফেলে রাখবে। তারপর একদিন শিক্ষার্থীর মা মরা গাছের চারাটি বাড়ির ঝি-কে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দিবেন। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়িয়েছে? গাছের চারা বিতরণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বনায়ন সৃষ্টি হয়নি। যদি চারার ঠিক সৎকার হতো, তাহলে অবশ্যই এত বছরে সমস্ত দেশ সবুজ সমারোহে পরিণত হতো। কিন্তু সে পরিমাণে বনায়ন সৃষ্টি হচ্ছে না, যে হারে চারা বিতরণ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ, হাজার কিংবা লাখ চারা বিতরণের প্রয়োজন নেই বরং স্বল্প সংখ্যক চারা বিতরণ করে তা রোপণ নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমরা নির্ধারিত কিছু জায়গা বেছে নিতে পারি। তাতে করে বৃক্ষরোপণ অভিযান সফল হবে। যেমন সরকারের প্রচুর খাসজমি রয়েছে। খালপাড়, নদীর পাড়, রাস্তার দু’পাশ, রেল লাইনের দু’পাশ— এসব জায়গা পড়ে আছে। পতিত এ স্থানগুলোকে আমরা অগ্রাধিকার দিতে পারি। শিক্ষার্থীদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করলে চিহ্নিত স্থানে রোপণের পরামর্শ দিতে পারি। প্রয়োজনে বনায়ন সৃষ্টিতে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা বাধ্যতামূলক করতে পারি। সেক্ষেত্রে অবশ্যই তাদেরকে ভূমির ব্যবস্থা করে দিতে হবে আগে। আমরা জেনেছি, এশিয়ারই একটি দেশ ‘ফিলিপাইন’-এ শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক কাজের অংশ হিসেবে বনায়ন সৃষ্টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তারা শুধু গাছ লাগিয়ে নম্বর পেয়ে যাবে তা নয়, গাছের পরিচর্যা করে দেখাতে হবে শিক্ষককে, তবে নম্বর মিলবে। ইচ্ছে করলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে এ ধরনের বিষয় জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। যেমন জুড়ে দেওয়া আছে গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে। আর হ্যাঁ, অবশ্যই শিক্ষার্থীদের মাঝেই নয় শুধু, কৃষক ও গৃহস্থদের মাঝেও বিতরণ করতে হবে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি কাউন্সেলিং করতে হবে বেশি বেশি। আমজনতাকে বোঝাতে হবে গাছের গুরুত্ব সম্পর্কে। মরুকরণ রোধে গাছের ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। ধারণা দিতে হবে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে গাছ কীভাবে মানুষকে আগলে রাখে সেটিও। গাছ থেকে আমরা অক্সিজেন পাচ্ছি সত্যি। কী পরিমাণে পাচ্ছি? তার ক্রয়মূল্য সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। গাছের ঔষধি গুণ সম্পর্কেও জানান দিতে হবে। তাতে করে বনায়ন সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা বেড়ে যাবে যেমন, তেমনি সফল হবে বৃক্ষরোপণ অভিযানও। গাছের চারা বিতরণ করেন এমন সামাজিক সংগঠনগুলোর প্রতি আমাদের অনুরোধ বিষয়টি নিয়ে ভাবার। আরেকটি বিষয় হচ্ছে চারা রোপণ করে রক্ষণাবেক্ষণ করা, যা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমরা লক্ষ করেছি কোনো কোনো সংগঠন রাস্তার পাশে শত-হাজার গাছের চারা রোপণ করছে প্রতি বছর। কিন্তু মাসখানেক যেতে না যেতেই দেখছি গাছের চারাটি গবাদিপশু কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছে অথবা পানিশূন্যতায় গাছটি অকালে মরে গেছে। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়িয়েছে! ফি বছর একই স্থানে আরেকটি চারা রোপণ করতে হচ্ছে। আর এই চারাটিও যে বেঁচে থাকতে পারবে তারও নিশ্চয়তা নেই। আমরা যদি এসব বিষয় মেনে গাছের চারা রোপণ করি, তাহলে স্বল্প সময়ের মধ্যে সমগ্র দেশে ব্যাপক বনায়ন সৃষ্টি হবে। আর এ সামান্য নিয়মনীতি মেনে চলতে পারলেই আমরা পাব নির্ভেজাল অক্সিজেন ফ্যাক্টরি। তবে সার্থক হবে আমাদের বৃক্ষরোপণ অভিযানও। বৃক্ষ নিয়ে আরেকটি বিষয়ে আলোকপাত করতে হচ্ছে। সেটি হচ্ছে ‘বনসাই’। বনসাই এক ধরনের শোভাবর্ধক উদ্ভিদ, বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষকে ছোট আকারে রেখে টবে পালন করা হয়। প্রাচীন চীনা শব্দ ‘পেনজাই’ থেকে জাপানি ‘বনসাই’ শব্দের উৎপত্তি। বনসাই শব্দের প্রকৃত অর্থ অগভীর পাত্রের গাছ। জাপানি ভাষায় ‘বন’ বলতে বোঝায় অগভীর ট্রে বা সিরামিকের পাত্র। আর ‘সাই’ হচ্ছে গাছ। এই দুইয়ে মিলে ‘বনসাই’ নামকরণ। তবে জাপানিরা বনসাই নাম দেওয়ার আগে এটিকে ‘হাচি-নো-কি’ (গামলার গাছ) নামে ডাকত। বলা হয়ে থাকে, বনসাই চীন দেশে উদ্ভূত এবং জাপানে বিকশিত। আপাতত চীনকে বনসাইয়ের জনক বলা হলেও তা ঠিক নয়। খ্রিস্টের জন্মের চার হাজার বছর আগে মিসরীয় ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৃতীয় ফারাও রামসেস পাথর কেটে পাত্র বানিয়ে তাতে জলপাই, খেজুরসহ অন্যান্য গাছ লাগিয়ে মন্দিরে সরবরাহ করতেন এবং রাজা-বাদশাহদের উপঢৌকন পাঠাতেন। এতে প্রতীয়মান হয় বনসাইয়ের জনক মিসরীয়রাই। বনসাই তৈরিতে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বনসাই শিল্পে যথেষ্ট অবদান রাখছে দেশের বনসাই চাষিরা। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত বনসাই মেলায় তার প্রমাণও মেলে। আমাদের দেশের সব ধরনের গাছ বনসাই তৈরির জন্য উপযুক্ত নয়। অপেক্ষাকৃত কষ্টসহিষ্ণু গাছ যেমন— বট, পাকুড়, কৃষ্ণচূড়া, বকুল, তেঁতুল, দেবদারু, জলপাই ইত্যাদি গাছ বনসাই তৈরির জন্য উপযুক্ত বলে জানা যায়। চীন, জাপান আর বাংলাদেশই কেবল নয়, বর্তমানে বনসাই গোটা এশিয়ায় ব্যাপক সামাদৃত। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা এ দেশের ধনী এবং শৌখিন লোকদের ড্রইংরুমে অনায়াসে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। এতে মূলত দুটি জিনিস বোঝাতে চায় তারা। এক. তাদের রুচিবোধ বেশ উঁচু; দুই. তার রয়েছে অঢেল অর্থবিত্ত। না হলে এত আকাশছোঁয়া দামে ‘পোষ মানানো’ একটি বুনোগাছ কিনে ঘরের ভেতর বন্দি করে রাখার মানেটাই বা কী? তবে মাথাব্যথা হতে পারে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে। ড্রইংরুমে বনসাই লালনের পাশাপাশি বিত্তবান বনসাইপ্রেমীরা প্রত্যেকেই যদি পাঁচটি করেও গাছ লাগাতেন তাহলে সর্বসাধারণ উদ্বুদ্ধ হয়ে হাজার হাজার গাছ লাগিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে পারত। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আসুন সবাই মিলে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে দেশটাকে সবুজে মুড়িয়ে দিই। তাহলে বনসাই-প্রেমও বিফলে যাবে না। লেখক : কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীবিষয়ক লেখক
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১