বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১০ May ২০২১

সুন্দরবন থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান


ভয়ংকর এই করোনাকালেও বন-বৃক্ষরাজির ওপর চলছে মনুষ্য খড়্গ। আগুনে আর কর্তনে ধ্বংস করা হচ্ছে বেঁচে থাকার অন্যতম উৎসস্থল সবুজে ঘেরা বনাঞ্চল। বেশ কদিন ধরেই সংবাদপত্রে সুন্দরবনে আগুন লাগার খবর ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। সুন্দরবনের ফায়ারিং খবর দেখতে দেখতে এবার দেখা হলো হাজারো উদ্ভিদে ঘেরা রাজধানীর প্রাকৃতিক নিঃশ্বাসস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বৃক্ষ কেটে বন দখলের পাঁয়তারা। সুন্দরবন থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত আগুনে ভস্মীভূতকরণসহ মূল্যবান গাছ কেটে হীন স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টায় সদা তৎপর হয়ে উঠেছি আমরা। আগুনের লেলিহান শিখায় যেমন প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারখ্যাত সুন্দরবন পুড়িয়ে ছারখার করছি, তেমনি স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ সৃষ্টির নীরব সাক্ষী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেঁচে থাকার সবুজ ভূষণ বৃক্ষ কর্তনের মাধ্যমে বাসযোগ্য রাজধানী তথা পৃথিবীকে অনিরাপদ করে তুলছি। আমাদের এই অনিরাপদ যাত্রা কোথায় গিয়ে ঠেকবে? কে রুখবে প্রকৃতির গায়ে মরণকোপ বসানো অপতৎপরতা?

৬ মে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় বন ধ্বংসের ছবিসংবলিত ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, গাছ কেটে রেস্টুরেন্ট’ ও শেষ পৃষ্ঠায় ‘সুন্দরবনে আবারো আগুন’ শিরোনামের সংবাদ বর্ণনায় উঠে এসেছে প্রাণ-প্রকৃতি উজাড়ি শঙ্কিত কথা। বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন একদিকে অজ্ঞাত অনলে ধ্বংস হচ্ছে অন্যদিকে ইতিহাসের কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রেস্টুরেন্ট ও জনচলাচলের ‘ওয়াকওয়ে’ নির্মাণে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ ও সংরক্ষণ প্রকল্পের (তৃতীয় পর্যায়) আওতায় সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর গাছ কেটে এ কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করছে। এ জন্য গত কয়েক মাসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কাটা হয়েছে মাঝারি আকৃতির প্রায় অর্ধশত গাছ।

এবার করোনা লকডাউনের নিভৃত পরিবেশে কাটা হচ্ছে উদ্যানের বড় বড় বৃক্ষ। গত কয়েক দিনে উদ্যানের ৩৮টি গাছ কাটার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় লাল ক্রস দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে আরো কমপক্ষে ৪০টি গাছ। অথচ গাছ বাঁচাতে ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ খুলে দেওয়া ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’ নির্মাণ করা হয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ চত্বরের ভূগর্ভে। কিন্তু রেস্টুরেন্ট ও ওয়াকওয়ে নির্মাণের প্রয়োজনে গাছ কেটে প্রায় দুই কোটি মানুষের মহানগরীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ঐতিহাসিক ও বিলুপ্ত বিভিন্ন গুল্ম, ফার্ন, ছত্রাক, লাইকেন, অণুজীব, পাখি, বেজি, কাঠবিড়ালি, সাপ, বাদুড়, প্রজাপতি, মৌমাছি, কেঁচোসহ নানা প্রাণীর আবাসস্থলকে হুমকির মধ্যে ফেলা হচ্ছে কি না তা ভেবে দেখছে না কেউ।

এমনিতেই প্রকৃতি দিনদিন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। সময়ে-অসময়ে ভয়াল প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়তে হচ্ছে পৃথিবী নামক এই মনুষ্য জগৎকে। তারপরও আমরা আমাদের মতো করে প্রকৃতিবিধ্বংসী আগ্রাসী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রকৃতির পিঠে পেড়েক টুকে ব্যক্তি, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান সকলে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করছি কেবল। এর পরিণতি কতটা ভয়ংকর থেকে ভয়ংকর হবে তা ভাবার প্রয়োজনীয়তা কেন আমরা অনুভব করতে পারছি না।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বৃক্ষ নিধনের খামখেয়ালিপনা দেখে প্রশ্ন জাগে, এই উদ্যান কী শুধু প্রকৃতিগত উপলক্ষই বহন করে চলেছে। না, বাংলাদেশ সৃষ্টির সজীব ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহন করে চলেছে এ উদ্যান। ১৬১০ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গড়ে ওঠা এই উদ্যান থেকেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতার। ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর এখানেই আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ১৯৯৯ সালে এখানে নির্মাণ করা হয় ‘শিখা চিরন্তন’। রাজধানীর ভূ-ভাগে অবস্থিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আগে রমনা রেসকোর্স নামে পরিচিত ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্থানটির নামকরণ করেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ বাঙালির জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে। দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের হাল ধরে জেগে থাকা প্রকৃতিগত সুরক্ষার সুবিস্তৃত বনভূমি সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলছে বৃক্ষ বিধ্বংসী কর্মতৎপরতা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। প্রতিবাদে সোচ্চার দেশের পরিবেশবাদী, মুক্তবুদ্ধিজন, শিল্পী-সাহিত্যিক, সংস্কৃতিজন, সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্টসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ উদ্যান এলাকাকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত না করে আগামী বর্ষায় এখানে আরো ১০ হাজার নতুন বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় বৃক্ষ লাগানোর দাবি জানিয়েছেন।

এই গাছ কর্তনের প্রতিবাদ করে শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পত্রিকান্তরে বলেছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই গাছ কাটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটা অত্যন্ত অন্যায় কাজ। আমাদের এই শহরে এমনিতেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক গাছ নেই। এটা সবদিক থেকে কেবল ক্ষতিরই কারণ হবে। গাছ কাটার কারণে শুধু এখানেই ক্ষতি হবে তা নয়, এখান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে উন্নয়নের নামে অন্য জায়গা থেকেও গাছ কাটা হবে। তার সঙ্গে একমত পোষণ করে বলতে চাই—প্রকৃতির নিরাপদ আনুকূল্য পেতে গাছ কর্তন নয়, রোপণ করাই উত্তম। উদ্যানের সজীব সম্পদ বিনাশ করে খাবার বিলাসী রেস্টুরেন্ট আর দল বেঁধে হাঁটার রাস্তা করতে হবে, এটা মানা যায় না। তবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও অপরিহার্য। এই অপরিহার্যতা বন বিনাশ করে নয়। বরং বনের সজীবতা রক্ষা করে অন্য উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

এবার আসি সুন্দরবনের কথায়। বিপুল সম্পদের অপর্যাপ্ত ভান্ডার সুন্দরবন। বিরল প্রজাতির বিভিন্ন উদ্ভিদ, অসংখ্য জলজ-স্থলজ প্রাণী ও জীবন-জীবিকার অন্যতম আশ্রয়স্থল সুন্দরবন বাংলাদেশকে আগলে রাখছে পরম মমতায়। একদিকে সেই সম্পদশালী সুন্দর, শুভ, শোভা বর্ধনকারী মাধ্যমটি প্রকৃতিগত ভয়ংকর দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের দক্ষিণাংশে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে থেকে রক্ষাকবচের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, অন্যদিকে বেঁচে থাকার মূল্যবান অক্সিজেন সরবরাহের পাশাপাশি নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে প্রকৃতিবৈরী পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করছে অনবরত। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশীদার সেই সুন্দরবন জ্বলছে আগুনে। গত ৩ মে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় আগুন লেগে পুড়েছে প্রায় ২ একর বন। প্রথমবার আগুন লাগার ৩০ ঘণ্টা পর ৪ মে বিকেলে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে জানিয়ে অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস ও বন বিভাগ। এর এক দিন পর ৫ মে সকাল ১০টার দিকে একই স্থানে আবার অগ্নিকা্লের ঘটনা ঘটে। এখন প্রশ্ন, এই আগুন কী প্রকৃতিসৃষ্ট না মনুষ্যসৃষ্ট। যদিও বন বিভাগ বোঝাতে চাইছে এ সময়টায় ভয়াবহ গরম থাকে, গাছপালা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, এলাকাটি মরুভূমির মতো, চোরা মাছ শিকারিদের বিড়ি-সিগারেটের আগুন, মৌয়ালদের মাছি তাড়ানো ধোঁয়ার আগুনে বনে আগুন লাগে ইত্যাদি।

এভাবে সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনা নতুন কিছু নয়। বরাবরই আগুন লাগছে, আবার সেটা নিভেও যাচ্ছে। ক্ষতি যা হওয়ার তো তা টের পাচ্ছে সুন্দরবন আর তার প্রাণিকুল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সাময়িক কিছু সময় দৌড়ঝাঁপ করে একেবারে ক্লান্ত হয়ে পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষায় দিন গুনে যায় কেবল। এর ধারাবাহিকতায় গত ১৯ বছরে সুন্দরবনে ২২ বার আগুন লেগে পুড়েছে প্রায় ৭২ একর বন।

বছরের পর বছর এসব আগুনে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হলেও আগুনের প্রকৃত কারণ কী খুঁজে বের করা সম্ভব হয়েছে। না, বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আগুন দেওয়া ভূত-প্রেতদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে বৈকি। গত ১৯ বছর ধরে অগ্নিকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারছে না বন বিভাগ। এতে করে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন আছে কি না সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। তবে আইন যে নেই, তা বলা যাবে না। আইন আছে, তার কার্যকর পদক্ষেপ নেই। তাই তো পশুপাখি, গাছপালা নিধন থেকে শুরু করে প্রকৃতিবিধ্বংসী সকল কাজই শক্ত হাতে সম্পাদন হচ্ছে। এগুলো দেখেও দেখছে না কেউ। প্রকৃতির সজীবতা রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের কঠোর হতে হবে।

 

লেখক : সাংবাদিক


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১