আপডেট : ১৭ April ২০২১
মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম ত্রিশ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে রক্তস্নাত সদ্য স্বাধীন এ ভূখণ্ডে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা ছিল জনগণের নিত্যসঙ্গী। মাত্র ৮ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনীতি নিয়ে ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। প্রধান রপ্তানি পণ্য শুধু পাট ও চা। বার্ষিক বাজেট ৭৮৬ কোটি টাকা। এর সিংহভাগই আবার বিদেশি অনুদান। মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলার। জীবনের আয়ুষ্কাল মাত্র ৪৭ বছর। বেকারত্বের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। দীর্ঘ সময়ে শোষণে নিষ্পেষিত জনগণের অধিকাংশই ছিল শিক্ষাবঞ্চিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভশূন্য। বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ৯ শতাংশ। এমন শূণ্য হাতে বঙ্গবন্ধু নেমে পড়েছিলেন সোনার বাংলা গড়তে। স্বপ্ন ছিল বিশ্বের বুকে মাথা উচু করে দাঁড়ানোর। বলেছিলেন, ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে তাঁর সঠিক নির্দেশনায় জাতীয় মাথাপিছু আয় কয়েকগুণ বেড়ে ১৭৩ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছিল। এই অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা আরও বেগবান করতে তখনকার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৩ সাল থেকে এলডিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য দর-কষাকষি চালিয়ে যায় বাংলাদেশ। এই প্রক্রিয়ায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। অবশেষে ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তালিকাভুক্ত হয়। কথা ছিল অতিদ্রুততম সময়ে নিজেদের অর্থনৈতিক ভিত মজবুত করে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে আসার। প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন নিজেদের বিশ্বের বুকে স্বনির্ভর এক উন্নত সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে। যাত্রা শুরু করেছিলেন এক অমিত সম্ভাবনার পথে। অথচ তাকে হারানোর পর পরই ১৯৭৬ সালে মাথাপিছু আয় নেমে যায় ১৩৯ মার্কিন ডলারে, তার পরের বছর আরো কমে হয় ১২৯ ডলার। বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী শাসনামলে পুরো সামষ্টিক অর্থনীতিতে দেখা দেয় স্থবিরতা, যা তৎকালীন বিভিন্ন গবেষণায় ফুটে ওঠে। নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড এবং মার্কিন অর্থনীতিবিদ জেআর পার্কিনসন ১৯৭৬ সালে লন্ডন থেকে ‘বাংলাদেশ দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ নামের একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। সেই বইয়ে তাঁরা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে উন্নয়নের একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। বাংলাদেশ যদি তার উন্নয়ন সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে যেকোনো দেশই উন্নতি করবে।’ সেই বাংলাদেশ শুধু আজ উন্নয়ন করছে না। বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে উন্নয়নের এক রোল মডেল। এবারে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণে যে তিনটি দেশ চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ- যে তিনটি সূচকেই শক্ত অবস্থান থেকে উত্তরণ হতে যাচ্ছে। এর আগে কোনো দেশই দুটির বেশি মানদণ্ড পূরণে সক্ষম হয়নি। বরং ইতঃপূর্বে যে পাঁচটি দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে এর মধ্যে বতসোয়ানা ও ইকোইটোরিয়াল গিনি শুধু মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করে এলডিসি থেকে বের হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও জাতীয় মাথাপিছু আয়সূচকে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে। তবে এবারের মূল্যায়ন অনুযায়ী অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতাসূচকে বাংলাদেশের ২৭ পয়েন্ট রয়েছে। ৩ বছর আগে এ সূচক ২৫ পয়েন্ট ছিল। তিন বছরের ব্যবধানে এ সূচকে অবনতি প্রায় ১৫ শতাংশের বেশি। মানদন্ড অনুযায়ী এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে এ সূচকে ৩২ পয়েন্ট বা এর নিচে থাকতে হবে। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতাসূচকে আগের চেয়ে খারাপ অবস্থানে গেছে বাংলাদেশ। এ সক্ষমতা কমে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। অবশ্য এর বহু আগেই বিশ্ব ব্যাংকের বিবেচনায় বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জুলাইয়ে নিম্নআয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। এখন বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া। অর্থনীতির আকারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ। ২০৩৩ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৪ তম বৃহত্তর অর্থনীতির তালিকায় নাম লেখানোর হাতছানি দিচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের এই দীর্ঘ পরিক্রমায় বড় ভূমিকা রেখেছে বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা। ২০০৯ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১২ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর্থসামাজিক ও অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বিশ্বের ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের যে কোনো সূচকের বিচারে গত দুই দশকে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে অভূতপূর্ব। ১৯৯০ সালের পর সার্বিকভাবে প্রবৃদ্ধিতে উন্নয়নশীল দেশের গড় হারের তুলনায় অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্যের হার কমে অর্ধেক হয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে মেয়েদের অবদানের হার দ্রুত বেড়েছে। জনসংখ্যা, গড় আয়ু, শিশু মৃত্যুর হার ইত্যাদি সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ সমপর্যায়ের উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশ, এমনকি প্রতিবেশী ভারতকেও পেছনে ফেলতে সমর্থ হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের এই সাফল্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ক্রমেই দক্ষিণ এশিয়ার ‘অর্থনৈতিক শক্তি’ হয়ে উঠেছে। গত এক দশকে রপ্তানি আয়ের ওপর ভর করে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ‘চাঙ্গা অর্থনীতির উদাহরণ’ সৃষ্টি করেছে। প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় রপ্তানি আয়ে অভাবনীয় উল্লম্ফন দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বিকাশমান তৈরি পোশাকশিল্প খাতের ওপর ভর করে এ সময় বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ডলারের হিসাবে ৮০ শতাংশ বেড়েছে। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার গৌরবের বিপরীতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে দেশকে। পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা থাকবে না। বাড়তি শুল্কের চাপে পড়ে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি কমে যাবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীর্ষ ১২ গন্তব্য দেশের ৭০ শতাংশ রপ্তানি বর্তমানে বাণিজ্যসুবিধার অধীনে হচ্ছে। সেই সুবিধা না থাকলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি ৫৩৭ কোটি ডলার বা ৪৫ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা কমতে পারে। এর বাইরে কৃষিতে ভর্তুকি অধিকতর স্বচ্ছ হতে হবে এবং সীমিত করতে হবে। নতুন শিল্পকে দেওয়া প্রণোদনা সীমিত হবে। উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের সুদহার বাড়তে পারে। ওষুধশিল্পে পেটেন্ট সুরক্ষার শিথিলতা শেষ হয়ে যাবে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও মেধাসম্পদ সুরক্ষার আন্তর্জাতিক বিধিবিধান কার্যকর হবে। পেটেন্ট নিবন্ধনে এখনকার চেয়ে ফি বাড়বে। ফলে সঠিক প্রস্তুতির অভাবে উত্তরণ-পরবর্তী কিছু বছর সাময়িকভাবে প্রবৃদ্ধিতে দেখা দিতে পারে ধীরগতি। অন্যদিকে এলডিসি থেকে উত্তরণ হলো বাংলাদেশের উন্নয়নের একটি বৈশ্বিক অনুমোদন। এর ফলে এদেশের বাজার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিংয়ে বাংলাদেশের উন্নতি হবে। বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। তাই পরবর্তী ১০ বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের আগের পাঁচ বছর (উত্তরণকালীন প্রস্তুতি) ও উত্তরণ-উত্তর পাঁচ বছর আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়ন হতে হবে। বৈষম্য হ্রাসের দিকে সুপরিকল্পিতভাবে নজর রাখতে হবে। অবশ্য বাংলাদেশে বৈষম্য ক্রমাগত বেড়ে চলছে। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। শুধু বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতার আশা না করে দেশের অভ্যন্তরে সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে। তা হলে উত্তরণ-পরবর্তী অর্থনীতি টেকসই হবে। যে পাকিস্তানের হাত থেকে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ, সেই পাকিস্তানিরা আজ বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। আমরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নের সমস্ত সূচকে পাকিস্তানকে অতিক্রম করেছি কয়েক বছর আগে। এই করোনাকালে যেখানে পৃথিবীর মাত্র ২২টি দেশ পজিটিভ ইকোনমিক জিডিপি গ্রোথ রাখতে সক্ষম হয়েছে তন্মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বঙ্গবন্ধুর সফলতা সেখানেই-যে পাকিস্তান সংশয় প্রকাশ করত বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে টিকবে কি-না, সেই পাকিস্তানের মানুষ শুধু নয়, তাদের প্রধানমন্ত্রীও আজকে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি দেখে আক্ষেপ করেন। নিম্নআয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। আর এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ আন্তর্জাতিকভাবে এই স্বীকৃতি-এ তো এক মর্যাদার লড়াই, গৌরবের লড়াই। বঙ্গবন্ধু আজীবন লড়াই করে আমাদের উপহার দিয়েছেন স্বাধীনতা। গড়তে চেয়েছিলেন ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা। আজ তাঁরই সুযোগ্য কন্যার দূরদর্শী ও দৃঢ় নেতৃত্বে সে পথেই দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আমরা পেতে যাচ্ছি অর্থনৈতিক মুক্তি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি। এই বীরের জাতি এখন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, উন্নয়নশীল দেশের পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে। এ অর্জন বঙ্গবন্ধুরই ফেলে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ। যা কাঁধে তুলে নিয়েছেন তাঁরই কন্যা, সঙ্গে রয়েছে বাংলার জনগণ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর শুভক্ষণে এই অর্জন-এটি তো বঙ্গবন্ধুকে এ জাতির শ্রেষ্ঠ উপহার। এ জাতি এখানেই তৃপ্ত থাকবে না, থেমে থাকবে না। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে পূর্ণ উদ্যমে এগিয়ে যাবে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ বাস্তবায়ন করে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদে সমৃদ্ধ, উন্নত মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে ঈর্ষণীয় সফলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বাংলাদেশ। লেখক : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক monirulislammi888@gmail.com
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১