বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২৮ March ২০২১

সহস্র প্রতিকূলতা পেরিয়ে অদম্য বাংলাদেশ


ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে সর্বপ্রথম পর্তুগিজরা ভারতীয় উপমহাদেশ বাণিজ্য করতে আসে। এই দেশ অপার সম্ভাবনাময় ও ধনসম্পদে ভরপুর থাকায় পর্তুগিজ ছাড়াও ইউরোপের অন্যান্য দেশ তথা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস ও স্পেন ভারতবর্ষে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এই দেশের নবাবদের রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগে ইংল্যান্ড ইউরোপের অন্যান্য বণিকদের বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় পরাজিত করে ভারতবর্ষে একচেটিয়া বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করে।

দেশীয় শাসকদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব ও কূটনীতিক শক্তির দুর্বলতার কারণে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দল সর্বত্র লেগে থাকত, বিশেষ করে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলার মসনদে আহরণের পরে ইংল্যান্ড তথা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় দাপটে বাণিজ্য করতে থাকে এবং সিরাজের প্রধান সেনাপতি মীরজাফর ও তার সহযোগীদের সঙ্গে  ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে ইংল্যান্ড। একপর্যায়ে পলাশীর প্রান্তে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার ভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইংল্যান্ড প্রায় দুইশ বছর ঔপনিবেশিক শাসনের নামে অমানুষিক ও নির্লিপ্তভাবে শোষণ করে।

বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে এই দেশের জনগণের রাজনৈতিক দক্ষতা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রজ্ঞা জাগ্রত হতে থাকে। এই ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও ভারতবর্ষ স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে যেতে থাকে যা ব্রিটিশকে বাধ্য করে এই দেশ ত্যাগ করতে। অতঃপর ১৯৪৭ সাল উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়, যেখানে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের জন্ম হয়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলেও পাকিস্তানের দুটি অঞ্চল ছিল তথা পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান। ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসন থেকে ভারত মুক্ত হলেও পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর নতুন সাম্রাজ্যবাদ শাসন চাপিয়ে দেয় পশ্চিম পাকিস্তান। সদ্য জন্ম নেওয়া পাকিস্তান পূর্ব বাংলার জনগণের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনচেতা বীর বাঙালি ১৯৫২ সালে বুকের রক্তের বিনিময়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষায় প্রতিষ্ঠা করেছে। সালাম রফিক জব্বার বরকত ও  নাম-না-জানা অনেক ভাষাশহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। পূর্ব বাংলায় তৎকালীন সময়ে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ও বাংলা সাহিত্যের জাগরণের সূচনা হয়েছিল। ত্রয়োদশ শতকে ইউরোপে রেনেসাঁর ফলে ইউরোপব্যাপী শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও বাকস্বাধীনতার নবজাগরণ হয়েছিল ঠিক একইভাবে এই দেশে বাংলা সাহিত্য ঢাকাকেন্দ্রিক নবজাগরণ সৃষ্ট  হয়েছিল। কেননা বাংলা সাহিত্য বলতে তৎকালীন সময়ে কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্য সভা বোঝাতো। তাই ভাষা আন্দোলনের ফলে শামসুর রাহমান, মনির চৌধুরী, জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সার, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, আহমেদ ছফার মতো মহৎ লেখক বাংলাদেশের সাহিত্যকে দিয়েছে জীবন্ত প্রাণ।

১৯৪১ থেকে ১৯৭১ সাল দীর্ঘ চব্বিশ বছর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ধর্মের দোহাই দিয়ে আমাদের শোষণ করেছে। যেখানে প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও  সামরিক বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়েছে আমাদের। তাই স্বাধীনচেতা বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানের নয়া সাম্রাজ্যবাদ শাসমের বিরুদ্ধে সর্বকালের শেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই দেশের সাধারণ জনগণ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানের সাথে আমাদের ধর্মীয়ভাবে সাদৃশ্য থাকলেও নৃগোষ্ঠীগত ও সাংস্কৃতিকভাবে বৈসাদৃশ্য রয়েছে। এই দেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক স্বাধীনচেতা আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী তা মেনে নিতে পারেনি। আমাদের ওপর ইচ্ছা মতো সামরিক দমন নিপীড়ন চালিয়েছে। ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পরোক্ষভাবে জনগণের কাছে পৌঁছে যায়। তথা এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। ২৬ মার্চ প্রত্যক্ষ স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমানচিত্রে জায়গা করে নেয়। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত, দারিদ্র্য-ক্ষুধা নিপীড়িত দেশকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী কিছু স্বার্থলোভী রাজনৈতিক চক্র ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে হত্যা করে। যার ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে নেমে আসে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা তথা ক্ষমতার পালাবদল বা নেতৃত্বের সংকট সৃষ্টি হয়। এই সময়কে বাংলার মাৎস্যন্যায়ের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সপ্তদশ ও অষ্টদশ শতকে বাংলায় মাৎস্যন্যায় ঘটেছিল, যেখানে রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে বাংলার শাসন ক্ষমতা নিয়ে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্ট হয়েছিল। এছাড়া একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকত, কোনো সুনির্দিষ্ট শাসক ছিল না। যে যেভাবে পারে, বাংলার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। ঠিক ’৭৫-পরবর্তী মাৎস্যন্যায়ের মতো বাংলাদেশও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যেখানে একের পর এক রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে থাকে। এই সূত্র ধরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। কেননা  মালয়েশিয়া ও কাতার আমাদের সাথে স্বাধীনতা লাভ করে আজ তারা বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ’৭৫-পরবর্তী যদি বাংলাদেশে রাজনৈতিক মাৎস্যন্যায় না ঘটত, তাহলে পাঁচ দশকের বাংলাদেশ  আজ অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বব্যাপী দাপটের সাথে তাল মিলিয়ে চলত। বর্তমানে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে যা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে আত্মপ্রকাশ করেছি, এটি আমাদের গৌরবের বিষয় তবে এই মর্যাদা আরো অনেক আগে পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেশীয় স্বার্থলোভী রাজনৈতিক চক্রের কারণে আমরা পিছিয়ে পড়েছিলাম। বর্তমানে বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। আবার সামাজিকভাবে তথা শিশু মৃত্যুর হার খাদ্য নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয় ছাড়াও আইএমএফের গত বছরের তথ্যমতে এই বছরে জিডিপিতে ভারতকেও বাংলাদেশ ছাড়িয়ে যেতে পারে এমন আভাস দিয়েছে। যে বাংলাদেশকে উপহাস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ি।’  আজ সেই আমেরিকা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও বিশ্বের বুকে রোলমডেল হিসেবে অদম্য এগিয়ে যাওয়ার অগ্রগতি দেখে ঢাকার দিকে ঝুঁকছে। প্রযুক্তি বিশ্বে বাংলাদেশ বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে চলছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন শহরে অত্যাধুনিক হাইটেক পার্ক নির্মাণে অব্যাহত রয়েছে। দেশের অবকাঠামো নির্মাণ ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রচলন ছাড়াও দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে আধুনিক প্রশিক্ষণ ও অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শক্তিতে জানান দিচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশের জন্য শুভকামনা ও আগামীর বিশ্বে বাংলাদেশ অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা হবে-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক :বিপ্লব আলী

শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১