বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২১ March ২০২১

সম্ভাবনাময় ই-কমার্স ও এফ-কমার্স


ই-কমার্স কিংবা এফ-কমার্স অনলাইনে কেনাকাটার বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। মানুষ এখন তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে মার্কেট বা শপিংমলে গিয়ে কেনাকাটা করতে চায় না। ফলে এই প্ল্যাটফরমগুলো বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে। সবাই ঘরে কিংবা অফিসে বসে প্রয়োজনীয় পণ্য অর্ডার করেন এবং ঘরে বসেই তা হাতে পেয়ে যান। আর এ কাজের জন্য ই-কমার্সের প্রসারের সাথে সাথে পণ্য ডেলিভারি করার অর্থাৎ কুরিয়ার সার্ভিসগুলোও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। কিছু কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ডেলিভারি সার্ভিস থাকলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ডেলিভারির জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল।

ই-কমার্সের সম্পূর্ণ কাজই ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ইন্টারনেট ব্যবহার করে ক্রয়-বিক্রয়, আর্থিক লেনদেন ও তথ্য আদান-প্রদান করা হয়, যা ই-কমার্স বা ই-বাণিজ্যের মূল ভিত্তি। ই-কমার্সের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহূত হয় ওয়েবসাইট, ইমেইলসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমে। ই-কমার্স মূলত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান (বিটুবি), ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টু ভোক্তা (বিটুসি), ভোক্তা টু ভোক্তা (সিটুসি)-এর মধ্যেই বেশি হয়ে থাকে। এ ছাড়া সরকারের সাথে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ভোক্তার সাথে সরকারের কিছু ব্যবসা কার্যক্রম ই-কমার্সের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে।

ই-কমার্স নামটির সাথে গত কয়েক বছরে আমরা বেশ পরিচিত হয়েছি। তেমনি বর্তমানে এফ-কমার্সও বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। তবে অনেকেই ‘ই এবং এফ’ কমার্সের পার্থক্য বুঝতে না পেরে এফ-কমার্সকে ই-কমার্স বলে থাকেন। এফ-কমার্স মূলত ই-কমার্সের একটি অংশ হলেও এর আলাদা আবেদন তৈরি হয়েছে। এফ-কমার্স ব্যাপারটি তুলনামূলক নতুন হওয়ায় আমাদের অনেকেরই এটা নিয়ে কনফিউশন থেকে যাচ্ছে। ই-কমার্স বলতে আমরা বৃঝি ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে ব্যবসা পরিচালনা করা। এখানে ই-কমার্সের সাথে সব ধরনের ইলেকট্রনিক মাধ্যমকেই সম্পৃক্ত বলে বিবেচনা করা হলেও বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচালিত ব্যবসাকে আলাদা নামে অর্থাৎ ফেসবুক কমার্স বা এফ-কমার্স নামে অভিহিত করা হয়েছে।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িকভাবে দারুণ লাভবান হচ্ছে। পণ্য, সেবা এবং বিশ্বস্ততা তাদের এই সাফল্যের দিকে ধাবিত করছে। যেহেতু অনলাইনে পণ্যের সঠিক অবস্থা না দেখেই পণ্য কেনাকাটা করেন তাই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই সততার সাথে পণ্য সরবরাহ করতে হয়। তা না হলে গ্রাহক আস্থা হারিয়ে ফেলবেন এবং ভবিষ্যতে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে আর পণ্য কিনবেন না। আবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে লাভের কথা চিন্তা করতে গিয়ে পণ্যের উৎপাদন বা সংগ্রহ করার দিকে বিশেষভাবে মনোযোগী হতে হয়। কারণ ক্রয় মূল্য বা উৎপাদন মূল্য বেশি হলে তাকে সেই পণ্য অধিক দামে বিক্রি করতে হবে। এদিকে ই-কমার্সে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি হওয়ার সুবাদে পণ্যের দাম অধিক হলে কেউ পণ্য কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করবেন না। তাই সবদিক বিবেচনায় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা সবচেয়ে কঠিন কাজ।

বিশ্বব্যাপী যে কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রাজত্ব করছে তার মধ্যে আমাজন, আলিবাবা, ই-বে, জিংডং, র্যাকুটেন, জালান্ডো, ফ্লিপকার্ট, ওয়ালমার্ট ইত্যাদি অন্যতম। তারা নিজ দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিশ্ব বাজারে তাদের পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমে সারা বিশ্বে আলোড়ন তৈরি করে চলেছে। এদের মধ্যে আমাজন ও আলিবাবা বাংলাদেশেও বেশ জনপ্রিয়। এ ছাড়া বাংলাদেশি যেসব ই-কমার্স প্ল্যাটফরম বেশ আলোচনায় রয়েছে তাদের মধ্যে দারাজ, রকমারি.কম, ইভ্যালি, চালডাল.কম, বিক্রয়.কম, প্রিয়শপ.কম, অথবা.কম ইত্যাদি। বাংলাদেশি প্ল্যাটফরমগুলো যদিও এখনো বিশ্বমানের সেবা দিতে সক্ষম নয়, তবুও এদের জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা যায় অনলাইনে বই বিক্রিতে রকমারির প্রতি মানুষের আস্থা আকাশচুম্বী। এর কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেসব বই প্রকাশনী ঘুরে ঝুঁজে পাওয়া যায় না, সেগুলো রকমারি সরবরাহ করছে। কিংবা কোনো লেখকের বই প্রি-অর্ডার সাপেক্ষে সবার আগে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি।

বর্তমানে এফ-কমার্স নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি এখন ফেসবুকের সাথে যুক্ত থাকায় ফেসবুকে ব্যবসা বা এফ-কমার্স বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফেসবুকে ব্যবসা পরিচালনা করা ই-কমার্সের তুলনায় আরো সহজ। কারণ এখানে আলাদা করে ওয়েবসাইট ম্যানেজ করার প্রয়োজন হয় না। ফেসবুক পেজ এবং গ্রুপের মাধ্যমেই ব্যবসা পরিচালনা করা যায়। ফলে ব্যবসা পরিচালনা করতে খরচ কম হয়। তরুণ উদ্যোক্তা বিশেষ করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে এফ-কমার্স পরিচালনাকারীর সংখ্যা প্রতিদিনই উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন এফ-কমার্স প্রসারিত হচ্ছে অন্যদিকে ব্যবসায় টিকে থাকার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সঠিক উপায়ে দক্ষতার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করতে না পেরে অনেকেই ব্যবসা থেকে ছিটকে যাচ্ছেন। তাই ই-কমার্স কিংবা এফ-কমার্স যেখানেই ব্যবসা করতে চান না কেন, আগে আপনাকে সঠিক পদ্ধতি জেনে সেগুলা অনুসরণ করতে হবে।

এফ-কমার্সের যাত্রা অনেক আগে থেকে হলেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে ২০১২ সালের পর থেকে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ২০১৯ সাল থেকে এর বাজারে এক ধরনের বিস্ফোরণ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন যার মধ্যে শুধু ঢাকাতেই ২০ মিলিয়ন। সুতরাং সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে কত বড় একটা বাজার তৈরি হয়েছে এই ফেসবুককে কেন্দ্র করে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ৩০০-৩৫০ কোটির বাজার এই ফেসবুক, যেখানে রয়েছে ৩ লাখেরও অধিক দোকান।

অর্থাৎ প্রায় ৩ লাখ মানুষ ফেসবুকে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এদের মধ্যে কিছু ব্যবসা বছরব্যাপী চলে, আবার কিছু রয়েছে সাময়িক। যেমন প্রায় ৫০০ উদ্যোক্তা রয়েছেন যারা গ্রীষ্মকালে আম নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করেন। ২০০ পেজ থেকে ইলিশ মাছ বিক্রি করা হয়। আসলে এই পরিসংখ্যানকেও এখন শতভাগ জোর দিয়ে সঠিক বলা যাচ্ছে না। এর কারণ করোনাকালে এফ-কমার্সের আরেক দফা বিস্ফোরণ ঘটেছে। ধারণা করা হচ্ছে শুধু করোনাকালেই কয়েক লাখ নতুন এফ-কমার্স পরিচালনাকারী তৈরি হয়েছে।

এফ-কমার্সে নারীদের অংশগ্রহণ ঈর্ষণীয় পর্যায়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঘরে বসে সহজে ব্যবসা করা যায় বলে অনলাইন ব্যবসায় তাদের উপস্থিতি বেশ সরব। প্রায় ৬০ ভাগ অনলাইন ব্যবসার কর্ণধার নারী। তাদের নিজেদের তৈরি হ্যান্ডমেড জিনিসপত্র, হোমমেড খাবার, কাস্টমাইজ কেক, কাস্টমাইজ পোশাক, হ্যান্ডক্রাফট ইত্যাদি ক্রেতাদের বেশ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হচ্ছে।

ই-কমার্স কিংবা এফ-কমার্স জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে তাদের কিছু স্পেশাল বিজনেস পলিসি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেমন, চলমান অফলাইন বাজার থেকে কম দামে পণ্য সরবরাহ করা, গ্রাহকদের হোম ডেলিভারি সুবিধা প্রদান করা, বিভিন্ন প্রমোশনাল অফার ও ডিসকাউন্ট প্রদান করা, ক্যাশ অন ডেলিভারি সার্ভিসসহ আরো নানান উপায়ে ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন। তবে এই ডেলিভারি নিয়েও অনেকের অভিযোগ রয়েছে যেমন, সময়মতো পণ্য হাতে না আসা বা ডেলিভারির সময়ে পণ্য নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যদিও এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিক্রেতার দোষ থাকে না, ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলার জন্য এরকম হয়ে থাকে।

অনলাইনে যে পণ্যগুলো সবচেয়ে বেশি ক্রেতাদের আকর্ষণ করে তার মধ্যে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক গ্যাজেট, পোশাক, ঐতিহ্যবাহী পণ্য, বিদেশি প্রসাধনী ও কসমেটিকস, সিজনাল ফল, ইলিশ মাছ, শুঁটকি ইত্যাদি। তবে বর্তমানে মাছ কোটার জন্য ব্যবহূত ছাই থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছু নিয়েই ব্যবসা পরিচালনা করছেন নতুন উদ্যোক্তারা। যারা সময়ের স্বল্পতার জন্য ছোট মাছ কুটতে পারেন না, যারা বিভিন্ন সবজি সঠিক সাইজে কাটতে পারেন না তাদের সেবার জন্য চালু হয়েছে ‘রেডি টু কুক’ নামের এক ধরনের উদ্যোগ। যেখানে মাছ কুটে, ধুয়ে, পরিষ্কার করে রান্নার উপযোগী করে আপনাকে ডেলিভারি করে দেয়। এককথায় বলতে গেলে নিত্য প্রয়োজনীয় এবং আপনার জীবনকে সহজ ও ঝামেলামুক্ত করতে যত ধরনের পণ্য ও সেবা প্রয়োজন তার সবই এখন অনলাইন বিজনেসের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা প্রদান করে যাচ্ছেন।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইক্যাব) বাংলাদেশে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ নিয়ে কাজ করলেও এফ-কমার্সের জন্য এরকম স্বীকৃত কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। তবে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, নারীদের এফ-কমার্সে সংযুক্ত করা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করছে উইমেন ইন ই-কমাসর্ (উই), নিজের বলার মতো একটি গল্পসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফরম। এছাড়া অঞ্চলভেদে উদ্যোক্তারা নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় কমিউনিটি ও ফোরাম গড়ে তুলছে।

তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো বৈধতা নেই বলে মনে করছেন ব্যবসা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা আরো মনে করেন অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনাকারী বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবসার সাথে জড়িত শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি আইন না জেনে এবং না মেনেই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তবে তাদের মতে, বৈধভাবে ব্যবসা করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা ইতিবাচক এবং অল্প সময়ের মধ্যেই সবাই একটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ব্যবসা করতে আগ্রহী হবেন।

সঠিক জ্ঞানের অভাবে এবং সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় না আসার ফলে ছোট ছোট উদ্যোক্তা ব্যাংকঋণসহ বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই ছোট ছোট উদ্যোগকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা এবং দিকনির্দেশনা প্রদান করলে এরাই একেকটি ব্র্যান্ডে পরিণত হতে পারে। ই-কমার্স নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সরকারি মহলে কিছু আলোচনা এবং কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও এফ-কমার্স নিয়ে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ চোখে পড়ে না। তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার আওতায় নিয়ে আসতে পারলে এই খাতটি আরো সম্ভাবনাময় হয়ে উঠবে এবং দেশের অর্থনীতিতে বড় একটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

লেখক :আরিফুল ইসলাম

শিক্ষার্থী, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১