আপডেট : ১৩ March ২০২১
রাজধানীর উত্তরায় আজমপুরের পূর্ব পাশে একটু হাঁটলেই চোখে পড়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি অফিস। পেছনেই রেললাইন, যেটি সারা দেশের রেলকে যুক্ত করেছে কমলাপুর স্টেশনের সঙ্গে। বেশ কিছুদিন আগে এই রেললাইনের দু’পাশের রেলের জমি দখল করে তৈরি করা হয়েছিল দোকানপাট। এমনকি এসব দোকানে ছিল অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ। এক সময় নজরে পড়লে উচ্ছেদ অভিযান চালায় রেল কর্তৃপক্ষ। ওই অভিযানের পর মাস দুয়েক ফাঁকাই ছিল পুরো জায়গাটি। কিন্তু এই ফাঁকা জায়গাতে নজর পড়ে ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের আলোচিত কাউন্সিলর ডি এম শামিমের। তিনি তার লোকজনকে দিয়ে আবারো দখল করে নেন ওই ওয়ার্ডের ভেতর দিয়ে যাওয়া রেললাইনের দু’পাশের এক কিলোমিটারেরও বেশি রেলের জমি। দখলের পর সেখানে নির্মাণ করা হয় কয়েকশ অবৈধ দোকান, এমনকি রয়েছে অবৈধ ভবনও। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রয়েছে মুদি দোকান। আর রিকশা গ্যারেজ থেকে শুরু করে রয়েছে ইট-বালুর ব্যবসা কেন্দ্র। সরেজমিন দেখা যায়, আজমপুর রেলগেট থেকে কসাইবাজার প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ। এছাড়া রেলগেট থেকে উত্তর দিকে আরো প্রায় ১ কিলোমিটার। এই জায়গা ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। দুই পাশে রেলের জায়গা উচ্ছেদের পর এখনো ফাঁকা। কিন্তু মাঝখানের এই স্থান আবারো দখল করা হয়েছে। ছোট ছোট ঘরের পাশাপাশি করা হয়েছে দোকান ও গ্যারেজ। ছোট চায়ের দোকানের জন্য এককালীন ১০ হাজার, আর মাসে ৪ হাজার টাকা ভাড়া, আর মুদি দোকানের জন্য এককালীন ২০ হাজার আর মাসে ৬ হাজার টাকা ভাড়া। গ্যারেজ ইট-বালু কিংবা ছোট বাসাবাড়ির জন্য আলাদা টাকা দিতে হয়। রেলগেটের পাশেই পঞ্চাশোর্ধ্ব চা দোকানি আবুল মিয়ার সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, দুই আড়াই মাস হয়েছে তিনি এখানে দোকান দিয়েছেন। সিকিউরিটি হিসেবে ১০ হাজার টাকা দেন। আর প্রতি মাসে ৪ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। বাদশা নামের একজনকে এ টাকা দিতে হয়। তিনি কাউন্সিলরের লোক। প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে এ টাকা দিতে হয় তাকে। রেলের জায়গা অবৈধভাবে দোকান করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাদশার গ্যারান্টিতে দোকান দিয়েছেন। অল্পদূরে এক হোটেল ম্যানেজার সুজন জানান, প্রতি মাসে ৬ হাজার টাকা ভাড়া দেন। আর দোকান নেওয়ার সময় কত টাকা দিতে হয়েছে সেটা জানেন না। এরকমভাবে কয়েকশ জনের কাছ থেকে দোকানের জন্য টাকা নেওয়া হয়েছে। আর রেলের এই জমি দখল করে এখন লাইনম্যান হিসেবে পরিচিত বাদশা আর কালাম টাকা উঠান। অনুসন্ধানে জানা যায়, কাউন্সিলরের ব্যক্তিগত সহকারী কানুন মোল্লা নিয়োগ দিয়েছেন বাদশা, বাতেন, শাকিল আর কালামকে। এখানে দোকান তৈরি, টাকা উঠানো, এমনকি অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়াও তাদের কাজ। এই দুজনেরও আবার কয়েকজন সহযোগী রয়েছেন। যারা পুরো এলাকাটি দেখাশোনা করেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কাউন্সিলরের নামে এই জমি দখল করা হয়েছে। প্রতি মাসে এসব দোকান থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা চাঁদা ওঠে। আব্দুর রশিদ নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকে শামিমের লোকজন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তার মদত না থাকলে রেলের জমি দখল সম্ভব নয়। শুধু রেলের জায়গা দখল করেই তারা লাখ লাখ টাকা খাচ্ছে। কাউন্সিলরের ব্যক্তিগত সহকারী কানুন মোল্লার সহযোগী তারা। এভাবে পুরো এলাকায় তারা দখলবাজি ও চাঁদাবাজি করে বেড়াচ্ছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে কারুন মোল্লা বলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। শনিবার (আজ) আমরা এ বিষয়ে মিটিং করব, কেউ যেন রেললাইন থেকে চাঁদাবাজি করতে না পারে। রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেন, কিছুদিন আগেই আমরা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছি। কাওরানবাজারের একটা বড় অংশ দখলে ছিল। সেটি আমরা মুক্ত করতে পেরেছি। এছাড়া অনেক এলাকাতে উচ্ছেদ অভিযান হয়েছে। এখন কেউ যদি আবার দখল করে তবে আবারো উচ্ছেদ অভিযান চালাব। রেলের জায়গা কেউ দখলে থাকতে পারবে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু রেলের জমিই নয়, পুরো ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের ফুটপাত থেকে শুরু করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা-সব জায়গা থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদা উঠানো হয়। পুরো ওয়ার্ডে প্রায় ৩/৪ হাজার অটোরিকশা চলে। প্রতি মাসে দেড় হাজার থেকে ১ হাজার ৭শ টাকা দিতে হয়। এর জন্য মাসে আলাদা টোকেন নিতে হয় প্রতিটি অটোরিকশাকে। প্রায় ১০ কোটি টাকা চাঁদা ওঠে ফুটপাত ও অটোরিকশা থেকে। স্থানীয়রা ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘স্কুলের সামনে ফুটপাতে দোকান বসিয়ে এলাকার নেতারা চাঁদাবাজি করছেন। শিশুদের স্কুলে নেওয়া-আসায় বেশ কষ্টের। অথচ দেখার কেউ নেই।’ নাম প্রকাশ না করে উত্তরার এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘আজমপুরের এই পূর্ব পাশটায় চাঁদাবাজির দখল নিয়ে মাঝে মাঝে সংঘর্ষ হয়। যে-কোনো সময় খুনোখুনির ঘটনা ঘটে যেতে পারে। দলের চাঁদাবাজ নেতারা এদের আশ্রয় দেন, চাঁদার ভাগ নেন।’ উত্তরার আজমপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের পূর্ব পাশ থেকে কাঁচাবাজার হয়ে রেলগেট পর্যন্ত ফুটপাতে বসানো হয়েছে দেড় হাজার অবৈধ দোকান। কাপড়, প্রসাধনী, জুতা-স্যান্ডেল, ফল, ফাস্টফুডসহ নানা ধরনের দোকান রয়েছে। দোকানভেদে প্রতিদিন চাঁদা নেওয়া হয় ২০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কাপড়ের দোকানদার বলেন, ‘প্রতিদিন সন্ধ্যায় ৬০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। কাউন্সিলর ডি এম শামীমের লোকেরা এসে চাঁদার টাকা নিয়ে যায়। একেক সময় একেক লোক আসে। ওদের কাউন্সিলরের লোক বলেই জানি আমরা।’ একজন জুতার দোকানি বলেন, ‘দয়া করে আমার নামটা লিখবেন না ভাই। তাহলে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। প্রতিদিন আমি চাঁদা দিই ৪০০ টাকা। রাতের বেলায় এসে টাকা নিয়ে যায় দেলোয়ার হোসেন রুবেলের লোকেরা। তবে এখানে ভাগাভাগি আছে। কিছু দোকান থেকে কাউন্সিলরের লোকেরা চাঁদা নেয়, আর কিছু দোকান থেকে নেয় রুবেলের লোকেরা। আবার কখনো কখনো এই দুজনের লোকেরা এসে চাঁদার টাকা দাবি করে। এ নিয়ে মারামারিও বাধে।’ ডি এম শামীম যুবলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সহসভাপতি এবং ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তরের ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। ওই ওয়ার্ডটি আগে ছিল আজমপুর ইউনিয়নে। পরে সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত হয়। আজমপুরে চাঁদাবাজিতে তার প্রতিপক্ষ উত্তরা থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন রুবেল। এলাকার ফুটপাতের দোকান এবং আজমপুরের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চাঁদাবাজির একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বর্তমানে এই দুই নেতার দ্বন্দ্ব চরমে রয়েছে। দুজনই চান চাঁদাবাজির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। ফলে দুজনই মহড়া দিচ্ছেন পেশিশক্তির। দুজনের আস্তানাও পাশাপাশি। দেলোয়ার হোসেন রুবেল রেললাইনের পাশে ঘর তুলে নিজের কার্যালয় গড়েছেন। আর রুবেলের আস্তানা থেকে মাত্র ৩০০ গজ দূরে দেওয়ান সিটিতে ডি এম শামীমের আস্তানা। এলাকাবাসী জানায়, প্রতি সপ্তাহে এই দুই নেতার লোকজনের মধ্যে ধাওয়াধাওয়ির ঘটনা ঘটছে। এতে এলাকাবাসী আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। আজমপুরের ওই এলাকায় দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একটি আজমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অন্যটি নবাব হাবিবউল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজ। দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গা ঘেঁষেও বসানো হয়েছে অবৈধ দোকান। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। এই ওয়ার্ডেই রয়েছে হাইওয়ে পুলিশের সদর দপ্তর। ওই দপ্তরের ফুটপাত ঘেঁষেও গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ দোকান। চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর যুবলীগ নেতা ডি এম শামীম বলেন, ‘আমি চাঁদাবাজি করি না। এলাকার কাউন্সিলর হিসেবে বরং চাঁদাবাজি বন্ধের চেষ্টা করি।’ আপনার নামে তাহলে কারা চাঁদা নেয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তা আমি জানি না।’
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১