বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২৩ January ২০২১

বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতা


মো. শামসুল হক

 

প্রবীণ রাজনীতিক মো. শামসুল হকের জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৮ জানুয়ারি মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর থানার তারাইল গ্রামে। ছাত্রাবস্থাতেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। মূলত ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময় যুক্তফ্রন্টের একজন কর্মী হিসেবে তার রাজনীতির পথচলা শুরু। তরুণ টগবগে কর্মী শামসুল হক নজর কাড়েন যুক্তফ্রন্টের প্রধান রূপকার মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর। ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠিত হলে মো. শামসুল হক তার সাথে সম্পৃক্ত হন এবং বৃহত্তর ঢাকা জেলা কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে ১৯৭৭ সালে তিনি বৃহত্তর ঢাকা জেলা ন্যাপের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় ন্যাপের শিল্প বিষয়ক সম্পাদক হন। ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করলে তার সাথে সম্পৃক্ত হন তিনি। তবে নীতিগত মতপার্থক্য এবং অন্যবিধ কারণে পরে আর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকেননি। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতির প্রতি রাখেন তীক্ষ নজর। মো. শামসুল হক বর্তমানে ৮৩ বছর বয়স অতিক্রম করছেন। অশীতিপর এই ব্যক্তিত্ব এদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের একজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং জীবন্ত সাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে বাংলাদেশের খবরের পক্ষ থেকে আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম এই বয়োবৃদ্ধ রাজনীতিকের। তার কাছ থেকেই জানব সে সময়ের কিছু কথা, শুনব স্বাধীনতা নিয়ে তার আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বাংলাদেশের খবরের পক্ষে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও রাজনীতিক মহিউদ্দিন খান মোহন।

বাংলাদেশের খবর : আপনি তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। খুব কাছ থেকে সবকিছু ঘটতে দেখেছেন। আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই শুভলগ্নে আপনার অনুভূতির কথা বলুন।

মো. শামসুল হক : প্রথমে আমি ধন্যবাদ জানাই দৈনিক বাংলাদেশের খবর কর্তৃপক্ষকে এমন একটি চমৎকার উদ্যোগ নেয়ার জন্য। বস্তুত আমাদের স্বাধীনতার অকথিত অনেক ইতিহাস আছে, যেগুলো এ ধরনের অনুসন্ধানী কাজের মাধ্যমে সবার সামনে আনা সম্ভব। তাই বাংলাদেশের খবর একটি বড়মাপের কাজে হাত দিয়েছে বলে আমি মনে করি।

দেশের স্বাধীনতা অর্জন প্রত্যক্ষ করা এক দারুণ অনুভূতির বিষয়! এ কথা ভাষায় ব্যক্ত করা দুরূহ। আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে, প্রিয় দেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং তার অর্ধশত বছর পূর্ণ হওয়ার ক্ষণ স্বচক্ষে দেখছি। এজন্য আমি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে কৃতজ্ঞ।

বাংলাদেশের খবর : আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছু বলুন।

মো. শামসুল হক : আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি ছিল একটি পূর্বনির্ধারিত বিষয়। দীর্ঘকাল আমরা ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের কবলে ছিলাম। অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে আমাদের। ব্রিটিশ উপনিবেশের পরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কলোনিতে পরিণত হয়েছিলাম। দীর্ঘ সংগ্রাম এবং একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। বস্তুত ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির সময়ই যেন সবার অলক্ষ্যে আমাদের এই দেশটির স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়েছিল। ভৌগোলিক দিকটির কথাই বলছি আমি। তারপর রাজনৈতিক কারণে সে বিষয়টি আরো অবধারিত হয়ে ওঠে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক এবং শোষক গোষ্ঠীর এ অঞ্চলের মানুষের প্রতি জুলুম-নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনা আমাদেরকে বিক্ষুব্ধ এবং বিদ্রোহী করে তোলে। নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে।

আমি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর খুব কাছের কর্মী ছিলাম। ফলে ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তবে বয়স হয়েছে তো! তাই বলার সময় ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে।

দেখো, স্বাধীনতা সংগ্রাম বলো, আর মুক্তিযুদ্ধ বলো, তা ছিল একটি জনযুদ্ধ। গুটিকয় দালাল ছাড়া এদেশের প্রায় সব মানুষ ওই যুদ্ধে শামিল হয়েছিল। কেউ প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে, কেউ মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করেছে, কেউ তাদের রসদ জুগিয়েছে। তাই আমি বলে থাকি, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে কমবেশি সবারই অবদান রয়েছে।

বাংলাদেশের খবর : মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? আপনি তো তার বিপরীত রাজনৈতিক আদর্শের রাজনীতি করতেন।

মো. শামসুল হক : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। তার নেতৃত্বেই এদেশের স্বাধীনতা এসেছে। বাংলাদেশকে স্বীকার করতে হলে বঙ্গবন্ধুকেও স্বীকার করতে হবে। হ্যাঁ, আমরা তার বিপরীত রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করতাম এটা ঠিক। কিন্তু সত্তরের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আমরা সবাই তার নেতৃত্বকেই মেনে নিয়েছিলাম।

বাংলাদেশের খবর : মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলুন।

মো. শামসুল হক : দেখো, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের সম্পর্কের কথা একবাক্যে বলা কঠিন। বিভিন্ন সময়ে তারা একসাথে কাজ করেছেন, আবার বিপরীত মেরুতেও অবস্থান করেছেন। তবে তাদের মধ্যে যে সুসম্পর্ক ছিল, তা কখনোই এতটুকু ম্লান হয়নি। মওলানা সাহেব কথা প্রসঙ্গে প্রায়ই বলতেন, আমার অনেক সেক্রেটারি ছিল। সবচেয়ে ভালো সেক্রেটারি ছিল মজিবর। তিনি বঙ্গবন্ধুকে এ নামেই ডাকতেন। এদেশের মানুষের মুক্তির প্রশ্নে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে সমর্থন করতে দ্বিধা করেননি। আর তাই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলার পর তাকে সমর্থন জানিয়ে ৯ মার্চ হুজুর পল্টন ময়দানের জনসভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার কথা বলেছিলেন।

বাংলাদেশের খবর : ১৯৭০-এর নির্বাচনে ন্যাপের অংশ না নেওয়ার কারণ কী?

মো. শামসুল হক : আমি তখন প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে মানিকগঞ্জে আমার নির্বাচনী এলাকায় ব্যস্ত। দেশের উপকূল অঞ্চলে ১২ নভেম্বরের জলোচ্ছ্বাসের পর উপদ্রুত এলাকা সফর শেষে ঢাকায় ফিরে হুজুর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেন। আমি ছুটে গেলাম তার কাছে। বললাম, এটা কী করলেন হুজুর? আমরা তো বেশ কয়েকটা আসন পেতাম। হুজুর বললেন, দুই চাইরটা আসন দিয়া কী করবি? এদেশের মানুষকে মুক্ত করতে পারবি? তার চেয়ে মজিবরকে আগাইয়া যাইতে দে।

বাংলাদেশের খবর : শুনেছি, ওই সময় মওলানা সাহেব বঙ্গবন্ধুর কাছে একটি ‘নতুন গামছা’ চেয়ে কিছু একটা ইঙ্গিত করেছিলেন।

মো. শামসুল হক : ঘটনা সত্যি। যতদূর মনে পড়ে, শেখ সাহেব সন্তোষে হুজুরের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি ওই কথা বলেছিলেন। হুজুরের গামছা চাওয়ার ইঙ্গিতটি বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ক্যামনে দিমু হুজুর। আপনি তো ইলেকশনই করলেন না। তখন হুজুর বলেছিলেন, আরে বেটা, আমি ইলেকশন করলে আমাগো ভোট ভাগ হইত না? আমি চাই তুই একক নেতা হ। এই দেশটাকে মুক্ত কর।

বাংলাদেশের খবর : তার মানে মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবের মধ্যে স্বাধীনতা নিয়ে একটা বোঝাপড়া আগে থেকেই ছিল?

মো. শামসুল হক : অবশ্যই ছিল। তাদের সম্পর্ক এত গভীর ছিল যে, অনেক সময় গোপনেও তারা দেখা-সাক্ষাৎ করতেন, কথা বলতেন, সলাপরামর্শ করতেন।

বাংলাদেশের খবর : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

মো. শামসুল হক : সে এক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। আমার জীবনে আমি অনেক জনসভা দেখেছি, জনসভা করেছি। ভাষণও দিয়েছি। কিন্তু একাত্তর সালের সাত মার্চে বঙ্গবন্ধুর জনসভার মতো বিশাল জনসভা আমি আর দেখিনি। সেদিনই বাংলাদেশের মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছিল, তারা বঙ্গবন্ধুর সাথে আছে, তার নেতৃত্বেই চলছে। আমি ওই জনসভার মধ্যেই ছিলাম। তার সেদিনের ভাষণই ছিল মূলত স্বাধীনতার কৌশলগত ঘোষণা। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতা। চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে তাকে বেশকিছু কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে। সাত মার্চের ভাষণ সেই কৌশলেরই অংশ। ওই ভাষণ থেকেই যে যার মতো বুঝে নিয়েছে পরবর্তীকালে কী করতে হবে।

বাংলাদেশের খবর : এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির কথা বলুন।

মো. শামসুল হক : যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সম্ভবত ১২ এপ্রিল ঢাকা থেকে মশিয়ুর রহমান যাদুমিয়া খবর পাঠালেন তিনি কলকাতা চলে যাবেন, আমি যেন আরিচাঘাটে তার জন্য নৌকাসহ সব ব্যবস্থা করে রাখি। আমি সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। যাদুভাইয়ের সাথে তার মেয়ে রিটা এবং ন্যাপ নেতা সিরাজুল হক মন্টুও ছিলেন। এর কয়েকদিন পরে আমিও কলকাতা যাই। সেখানে কাজী জাফর আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরীসহ অনেকের সাথে দেখাও হয়। কিন্তু ভাসানী ন্যাপের লোক বলে আওয়ামী লীগ নেতারা আমাদের বাঁকাচোখে দেখতে থাকে। একপর্যায়ে আবার দেশে ফিরে আসি। তখন যোগাযোগ হয় ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরীর সাথে। তিনি তখন যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারপর থেকে যুদ্ধের গোটা সময় হালিম চৌধুরীর সাথে সহযোগিতা করেছি। তবে আমি সনদধারী মুক্তিযোদ্ধা নই। মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী।

বাংলাদেশের খবর : মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মো. শামসুল হক : ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ও বন্ধু, সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আমাদের চরম বিপদের দিনে তারা পরম বন্ধুর মতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের এক কোটি মানুষকে প্রায় এক বছর থাকা, খাওয়া, চিকিৎসাসহ সব ধরনের ব্যবস্থা করেছে। সেজন্য আমি ভারতের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং দেশটির তৎকালীন সরকার অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ভারতের সহযোগিতা ছাড়া আমরা হয়তো এত দ্রুত স্বাধীনতা লাভ করতে পারতাম না। 

বাংলাদেশের খবর : আমরা আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছি। এই পঞ্চাশ বছরে এসে আপনার কি মনে হয় যে প্রত্যাশা নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তা পূরণ হয়েছে?

মো. শামসুল হক : এক কথায় এর জবাব দেওয়া সহজ নয়, সম্ভবও নয়। প্রথমত আমাদের প্রথম প্রত্যাশা ছিল দেশকে স্বাধীন করা, সেটা অবশ্যই পূরণ হয়েছে। প্রথম এবং প্রধান প্রত্যাশা পূরণের পর অন্য বিষয়গুলো এসে পড়ে এটা ঠিক। যেমন— গণতন্ত্র, বাক্স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইত্যাদি। একথা বলা যাবে না সেসব প্রত্যাশা একেবারেই পূরণ হয়নি। আবার এও বলা যাবে না যে, তা সর্বাংশে পূরণ হয়েছে। আসলে কোনো প্রাপ্তিই পরিপূর্ণ হয় না। আরো আশা থেকে যায়। গত পঞ্চাশ বছরে আমরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছি, যেটা স্বাধীনতা না এলে হতো না। তবে গণতন্ত্র বার বার হোঁচট খেয়েছে। এটা সরকার পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সংকীর্ণতার কারণে হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন দলগুলো গণতন্ত্রের প্রশ্নে এখনো আক্ষরিক অর্থে উদার হতে পারেনি। যেজন্য গণতন্ত্র কাঙ্ক্ষিত রূপ লাভ করতে পারেনি।

বাংলাদেশের খবর : এ অপূর্ণতার কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

মো. শামসুল হক : গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পাওয়ার পেছনে আমাদের দেশের রাজনীতিকদের ব্যর্থতাই মূলত দায়ী। তারা আমলানির্ভর রাজনীতি করেন। গণতন্ত্র বিকশিত না হওয়ার কারণে আমলাতন্ত্র রাজনীতির ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে। রাজনীতিকরা যদি সচেতন না হন, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতির কোনো আশা নেই।

বাংলাদেশের খবর : দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

মো. শামসুল হক : এ এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। এই বৃদ্ধ বয়সে যা দেখছি, তাতে শুধুই হতাশ হচ্ছি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহাবস্থান নেই। তারা একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, ভাবে শত্রু। ফলে একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার একটি অপ্রকাশিত নীতি অনুসরণ করে; যা দেশ ও রাজনীতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। রাজনীতিকরা একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না। এক দল আরেক দলের সাথে কথা বলে না, এমনকি মুখ দেখাদেখিও নেই। এভাবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা যায় না।

বাংলাদেশের খবর : অনেকে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের কথা বলেন। আপনার অভিমত কী এ বিষয়ে?

মো. শামসুল হক : রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন একটি দৃশ্যমান বিষয়। এখন রাজনীতির মাঠে দুর্বৃত্ত-দুষ্কৃতিকারীদের দাপট প্রবল। অসৎ লোকজন জায়গা করে নেওয়ায় সৎ ও দেশপ্রেমিক মানুষেরা রাজনীতির মাঠ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তারা হতাশাগ্রস্ত। এ অবস্থা চলতে থাকলে স্বাধীনতার মূল যে লক্ষ্য তা অর্জন করা আরো কঠিন হয়ে পড়বে। 

বাংলাদেশের খবর : আপনি আপনার জীবনের একটি বড় অংশ রাজনীতির মাঠে বিচরণ করে কাটিয়েছেন। আপনি মওলানা ভাসানীর খুব কাছের এবং স্নেহভাজন ছিলেন। তিনি ছাড়াও অনেক নেতার সান্নিধ্যে এসেছেন। তাদের চরিত্রের কোন দিকটি আগামী প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয় বলে আপনি মনে করেন?

 মো. শামসুল হক : দেশপ্রেম, মানবপ্রেম। মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যার কথাই বলো, তাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র ছিল দেশপ্রেম। দেশকে ভালোবেসেই তারা রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। আর সেজন্যই তারা আজো প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন। কিন্তু এখন সে দেশপ্রেমের খুব অভাব দেখি নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে। পরিবর্তে আত্মস্বার্থ হাসিল ও আত্মলোভ তাদেরকে বিভ্রান্তির পথে নিয়ে যাচ্ছে। এটা আমাকে ভীষণভাবে পীড়া দেয়।

বাংলাদেশের খবর : বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনার কোনো স্মৃতির কথা কি মনে পড়ে?

মো. শামসুল হক : অনেক স্মৃতিই আছে। তার সাথে আমার অনেকবার দেখা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ হুজুর, মানে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে। একটি স্মৃতির কথা খুব মনে পড়ে। ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে আমি মানিকগঞ্জের ঘিওর-দৌলতপুর আসনে ন্যাপের মনোনীত প্রার্থী হয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়ছি। এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত। খবর পেলাম হুজুর অসুস্থ, পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ছুটে এলাম ঢাকায়। রাতে যখন হাসপাতালে পৌঁছলাম তার একটু পরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এলেন হুজুরকে দেখতে। একথা সেকথার পরে বঙ্গবন্ধু তার মাথাটা এগিয়ে দিয়ে হুজুরকে বললেন, হুজুর আমাকে দোয়া করে দেন। হুজুর তাঁর হাতটি বঙ্গবন্ধুর মাথায় দেওয়ার অগেই আমি হাতটি ধরে বললাম, হুজুর আমাকে আগে দোয়া করেন। হুজুর হেসে দিয়ে বললেন, আমি তোদের সবাইকে দোয়া করি। এই বয়সে আমি কাউকে কি বদদোয়া করতে পারি? তিনি বঙ্গবন্ধুর মাথায় হাত বুলালেন, আমার মাথায়ও।

বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, শামসুল, তুই আর কয়দিনের ছেলে? আমি হুজুরের সাথে জীবন কাটিয়েছি। তোর আর আমার মধ্যে পার্থক্য অনেক। আমি বললাম, তা তো অবশ্যই। আপনি মহান নেতা। আপনার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আপনার সাথে কি আমার তুলনা হয়? বঙ্গবন্ধু আমার কাঁধে একটু চাপ দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, ইলেকশন করগা। আসলে তাঁর হূদয়টা ছিল আকাশের মতো উদার।

বাংলাদেশের খবর : নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে কিছু বলুন।

মো. শামসুল হক : আমি তাদের উদ্দেশে একটিই কথা বলতে চাই, দেশকে ভালোবাসতে হবে। আর দেশকে ভালোবাসতে হলে এর ইতিহাস জানতে হবে। আর ইতিহাস জানার জন্য দরকার প্রচুর পড়াশোনা। আজকালকার ছেলেপেলেরা বই পড়তে চায় না। ইতিহাসে তাদের আগ্রহ কম। তাই একটি দেশপ্রেমহীন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। যে কোনো জাতির জন্য এমন পরিবেশ অশনিসংকেতের মতো। লেখাপড়াহীন রাজনীতি কখনো দেশ ও জাতির কল্যাণ করতে পারে না।

বাংলাদেশের খবর : এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আপনি কি হতাশ?

মো. শামসুল হক : আমি আশাবাদী মানুষ। হতাশায় ডুবতে চাই না। আমি মনে করি, বাংলাদেশের সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। যে জাতি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, তারা কখনো অপশক্তির কাছে, দুর্নীতির কাছে হেরে যাবে না। বাংলাদেশ একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবেই। আমি আজ জীবন সায়াহ্নে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়েই মরতে চাই। পরবর্তী প্রজন্ম সে বাংলাদেশ গড়বে এবং দেখবে ইনশা আল্লাহ।

বাংলা : আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

মো. শামসুল হক : ধন্যবাদ।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১