বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০১ January ২০২১

জীর্ণতা মুছে শুরু হোক নতুন বছর


গেল বছর কেমন ছিল? এমন প্রশ্নে সবার কমন উত্তর হচ্ছে আতঙ্কের। সেই আতঙ্কের নাম হচ্ছে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। ভাইরাসটি ছিল আন্তর্জাতিক আতঙ্ক। মানব ইতিহাসের অন্যতম একটি বিপর্যয়। বাংলাদেশে এই ভাইরাসের আতঙ্ক জনমনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। অদৃশ্য এমন ভাইরাসের চেয়েও বাংলাদেশে আরো অনেক আতঙ্ক সারা বছরই বিরাজ করে। নারীদের কাছে এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছে বড় আতঙ্ক হচ্ছে দুর্নীতি, খুন-ধর্ষণ-নিপীড়ন। মানুষ এর বিরুদ্ধে জেগে উঠে প্রতিবাদ করছে। সরকারও কঠোর অবস্থান নিয়েছে; ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তির আইন করেছে। কিন্তু এখনো এই ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি থেকে আমাদের নারী-শিশুরা চূড়ান্ত মুক্তি পায়নি। সহজেই এই সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি মিলবে না। সেজন্য অনেক ধরনের সংস্কারমূলক কাজ করতে হবে। অন্যদিকে গত কয়েক বছর থেকে বাংলাদেশে খুন-ধর্ষণ-নিপীড়ন অনেক বেড়েছে। তবে আশার দিক হচ্ছে, গত কয়েক বছরের তুলনায় গেল বছর বাংলাদেশে ধর্ষণের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। কিন্তু নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণের ভয়াবহ কিছু ঘটনা প্রমাণ করেছে পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনা, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনায় মানুষের মধ্যে ভয়াবহ আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

 

সারা দেশে হত্যা-নিপীড়ন এতই বেড়েছিল যে, সাধারণ মানুষ পথে নেমে প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়েছে। কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। হিসাব বলছে, গত ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৬১ জন মানুষ ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আশার দিক ছিল, জনতার প্রতিবাদে ক্রসফায়ারে হত্যা অনেকটাই কমে গেছে। গেল ১১ বছরের মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কোনো ক্রসফায়ারে হত্যার ঘটনা ঘটেনি। বিগত কয়েক বছরে দেশের আইনশৃঙ্খলার যে অবনতি হয়েছিল, গেল বছরের শেষদিকে এসে পরিস্থিতির ভয়ানক চিত্র পরিমাণে কমেছে। জনতার প্রতিবাদ যেমন কাজে দিয়েছে, তেমনি সরকারের আন্তরিকতাও লক্ষণীয় ছিল।

 

গেল বছর আরো একটি বড় কাজ হয়েছে, দেশে ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। এই অভিযানে এমন কিছু মানুষ ধরা পড়েছে, যারা ক্ষমতাসীন রাজনীতির সাথে জড়িত। কিন্তু তারপরও তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এটা আশার দিক। তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য বলছে, রাঘব-বোয়ালরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। নতুন বছরে প্রত্যাশা থাকবে সরকার যেন সেই রাঘব-বোয়ালদের আর ছাড় না দেয়। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর হচ্ছে। স্বপ্ন ছিল শোষণ-বৈষম্য-দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক সাম্যবাদী সমাজ গঠনের। এখনো সেই সমাজ গঠনের পথ থেকে অনেক দূরে আছে বাংলাদেশ। দেশে রাঘব-বোয়ালদের দুর্নীতি, কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের ওপর শোষণ-বঞ্চনা লাঘবের অন্যতম প্রতিবন্ধক। সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে সরকার যে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেছিল সেটা চলমান রাখতে হবে এবং কেবল চুনোপুঁটি না ধরে রাঘব-বোয়ালদেরও ধরতে হবে। তবেই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সফল হবে।

 

বাংলাদেশের বয়স যতদিন, ততদিনই হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ারে ও নির্যাতনে হত্যার বয়স। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে মানুষ হত্যার সবচেয়ে ভয়াবহ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে সাম্প্রতিক কিছু হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যা। গত বছরের বেশকিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের মানুষ ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু করে। এর ফলে সরকার এসব হত্যা ও নির্যাতনের লাগাম কিছুটা টেনে ধরে। এটা জনতার প্রতিবাদের অর্জন। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিপীড়নের ঘটনা তেমন কমেনি। নানা সময়ে বিনাদোষে সাধারণ মানুষের ওপর রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু ব্যক্তি কর্তৃক নির্মম নিপীড়নের ঘটনা সামনে এসেছে। এর মধ্যে সিলেটে এসআই আকবরের ঘটনা সারা দেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছে। মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। তাকেও আইনের আওতায় নেওয়া হয়েছে। মনে রাখা উচিত, কেবল আইন করে অপরাধ দমন সম্ভব নয়। তার জন্য চাই নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টি। বাংলাদেশে ধর্ষণ বন্ধে জনতার জাগরণ, সরকারের আইনি কঠোর পদক্ষেপ, জনসচেতনতা ও শিক্ষা-সংস্কৃতিগত পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে ধর্ষণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব। তেমনি রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক নানা সময়ে যে ভয়াবহ নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে, সেগুলোও কেবল আইন প্রয়োগ করে বন্ধ করা যাচ্ছে না, এটা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। সেজন্য দরকার তাদের মধ্যে পেশাগত নৈতিকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া। নতুন বছরে সেটা একান্ত আরাধ্য। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০১৫ সাল থেকে গেল বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নানা সময়ে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে দেড় হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। খুবই ভয়াবহ তথ্য। নতুন বছরে দেশের সাধারণ মানুষ এমন ভয়াবতা থেকে রক্ষার প্রত্যাশা করে।

 

নতুন বছরের শুরুতেই সারা বিশ্ব করোনাভাইরাসের মহামারীর ফলে বিশ্ব যেভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছে, বর্তমান আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের এত অগ্রগতির পরও এমনটা হবে তা মানুষের ভাবনায় ছিল না। কিন্তু করোনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, আমরা স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাত নিয়ে এখনো অনেক উদাসীন রয়েছি। এ নিয়ে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেমন, তেমনি বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর অবস্থা। পারমাণবিক বোমা কিংবা উঁচু দালান, জিডিপির আকাশচুম্বী হিসাব মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারে না- এটা বিশ্বের কাছে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ বাঁচাতে হলে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষা করে উন্নয়নের বিকল্প নেই এটা খোলাসা হয়ে গেছে। মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশের করোনা সংক্রমণ শুরু হলে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যখাতের দশা কতটা নাজুক, সেটা স্পষ্ট হয়েছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল তা সবাই দেখেছে। পরিবেশ বিধ্বংসী উন্নয়ন কত বড় মহামারী ডেকে আনতে পারে, সেটাও স্পষ্ট হয়েছে। চিকিৎসাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য খাতকে উপেক্ষা করার ফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে, সে শিক্ষাও হয়েছে। নতুন বছরে সেই শিক্ষা কাজে লাগানোর প্রত্যাশা দেশের প্রতিটি মানুষের। বাংলাদেশের উন্নয়নের সাথে সে শিক্ষা যুক্ত করে নতুন বছর শুরু হোক- এই প্রত্যাশা সবার।

 

সারা বছরই কেটেছে মৃত্যুর ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে। জাতিসংঘের গোপন এক প্রতিবেদনের পূর্বাভাস ছিল করোনায় বাংলাদেশে ২০ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে। কিন্তু সেই ভয়াবহ ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়নি। বাংলাদেশের জিডিপি নিয়েও যে নেতিবাচক ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, সেটাও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এগুলো দেশের মানুষেরই সফলতা। নতুন বছরে সেই সফলতা আরো পোক্ত করা দরকার। ইতোমধ্যে করোনার কারণে দেশের বৃহৎ রপ্তানি খাত গার্মেন্টসহ অন্যান্য শিল্প খাতেও উৎপাদনে ভাটা পড়েছে। কয়েক লাখ মানুষ নতুন বেকার হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে, তরুণ প্রজন্মের মনে ক্রমেই হতাশার ছায়া বাড়ছে। নতুন বছরে এসব কাটিয়ে ওঠা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে। তাই রাষ্ট্রীয় পলিসি তৈরিতে উক্ত বিষয়গুলো নজরে নিতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশে যে পরিমাণে বেকার জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, ভবিষ্যতে ‘বেকার বিস্ফোরণ’ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। বিষয়টি কোনোভাবেই উপেক্ষার নয়।

 

আমাদের সবচেয়ে বড় অশিক্ষা হচ্ছে আমরা শিক্ষা নেওয়ার দৃষ্টান্ত সামনে থাকলেও শিক্ষা নিই না। এই জড়তা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন বছর নতুনভাবে শুরু হোক।

 

জি. কে. সাদিক

সাংবাদিক ও কলাম লেখক, কুষ্টিয়া


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১