বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২২ December ২০২০

শীতে কাঁপছে দেশ ও মানবতা


আকিজ মাহমুদ

 

 

 

বাংলা পঞ্জিকায় শীতের মাস পৌষের আগমন ঘটেছে। কিন্তু শীত এসেছে আরো আগেই, অগ্রহায়ণে। শীতের প্রকোপ এরই মধ্যে বুঝিয়ে দিচ্ছে এই বছরের শীতটা মোটেও বনভোজনের আনন্দে যাবে না। আবহাওয়া অফিসও বলছে, এবারের শীতের প্রকোপ তীব্রতর হয়ে উঠবে। পৌষের শুরুতেই উত্তরাঞ্চলে শীতের এমন নির্দয় অবস্থায় নাকাল মানুষজন। প্রত্যেক বছরের তুলনায় মহামারী করোনার জন্য এবারের শীতকাল উত্তর অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে আরো বেশি আতংক এবং হতাশার সৃষ্টি করছে। শীতের এই সময়ে এমনিতেই নিম্ন রোজগারে জীবন-যাপন করা মানুষদের দুর্ভোগের অন্তিম থাকে না। বিশেষত শীতের এই সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং মধ্যাঞ্চলের নিম্নআয়ের মানুষদের নিদারুণ কষ্টে জরাজীর্ণ জীবনযাপনের দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। শীত নিবারণ করতে ন্যূনতম বস্ত্র পরিধান করতেও অনেকে সক্ষম হন না।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ছোট ছোট শহরগুলোতে রাতের আঁধারে ঘুরলে পথশিশু, আশ্রয়হীনদের শীতের চরম কষ্টসাধ্য রাত অতিবাহিত করার দৃশ্যও খুব কাছ থেকে দেখা মেলে। গ্রামীণ জনপদে শীতের প্রকোপ আরো ভয়াবহ। গ্রামের গরিব অসচ্ছল পরিবারগুলো কেবল যৎসামান্য আহার্যে শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার বৃথা চেষ্টা করে, অধিকাংশই গরম কাপড়ের অভাবে কাজে যেতে না পেরে গৃহবন্দি হয়ে থাকে।

শীতের হিমেল হাওয়া যখন প্রান্তিক দরিদ্র পরিবারগুলোর বাড়ির আঙিনা দিয়ে বয়ে যায়, তখন হঠাৎই যেন তাদের মায়াভরা স্বপ্নের চোখগুলো ছলছল করে ওঠে। কেউ আসুক তাদের সাহায্য করতে, এটিই হয়ে ওঠে তাদের শ্রেষ্ঠ অনুনয়। কিন্তু নির্মম সত্য এই যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ন্যূনতম সাহায্যও তাদের কাছে পৌঁছে না। তাদের কষ্ট সামর্থ্যবানদের উষ্ণতার বস্ত্র ভেদ করে তাদের মানবিকতাকে জাগ্রত করতে পারে না।

মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে নিম্নআয়ের দিনমজুর, রিকশাচালক, আশ্রয়হীন পথশিশু, ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনাতিপাত করা লোকজন এমনিতেই খুব নিঃস্বভাবে জীবনযাপন করছে, তার ওপর শীতের প্রকোপ তাদের কাছে যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে উঠেছে। আগের তুলনায় বর্তমানে মহামারী করোনার কারণে এই নিম্নশ্রেণির মানুষগুলোর রোজগার আরো কমে গেছে। দেশে আগে থেকেই শীতার্তদের মাঝে মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া লোকের সংখ্যা সাহায্যপ্রত্যাশীদের চেয়ে অনেক কম, এই বছর তা আরো কম হবে বলেই অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায়।

বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে পথশিশু ও ছিন্নমূল শিশু-কিশোরের সংখ্যা ১০ লাখেরও অধিক, যার ৬০ শতাংশেরই নিবাস রাজধানী ঢাকায়। ২০ শতাংশ চট্টগ্রামে এবং বাকি ২০ শতাংশ থাকে অন্যান্য জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোয়।

এছাড়া দেশে বর্তমান ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনযাপন করা লোকের সংখ্যা আড়াই লাখেরও বেশি। পাশাপাশি দেশে  শহর থেকে প্রান্তিক পর্যন্ত হতদরিদ্রের সংখ্যাও প্রচুর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের তথ্যমতে, দেশে দরিদ্রের হার ২০.৫ শতাংশ এবং হতদরিদ্রের হার ১০.৫ শতাংশ।

যাদের অধিকাংশই আবার গ্রামে বসবাস করে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রায় সবারই শীতকালীন এবং অন্যান্য দুর্যোগকালীন সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে। সরকার দুর্যোগ মোকাবিলায় যে অর্থ বরাদ্দ করে থাকে তা বিপুলসংখ্যক এই মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় অতিনগণ্য। অপরদিকে সরকার প্রদত্ত আর্থিক সহায়তা অনেক সময় দুর্নীতিপরায়ণ নেতা, সরকারি চাকরিজীবীদের কারণে ছিন্নমূল লোকজন এবং প্রান্তিক জনপদ পর্যন্ত পৌঁছে না।

মহামারীর দ্বিতীয় তরঙ্গ এবং শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় আগের তুলনায় বেশিরভাগ মানুষই প্রয়োজন ছাড়া এখন ঘর থেকে বাইরে বেরও হচ্ছেন না। ইন্টারনেটের কল্যাণে অনেকেই প্রয়োজনীয় যাবতীয় দ্রব্যাদি অনলাইন থেকেই খরিদ করে নিচ্ছেন। এতে করে রাস্তায় ভিক্ষা করা ভিক্ষুক, পথশিশু যারা কি না সাধারণ মানুষের মুখাপেক্ষী থেকে তিন বেলা আহার জোগায়, সেটুকুও তাদের ঠিকমতো জুটছে না। রিকশাচালক, দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষগুলো উপার্জনের জন্য শীতের কাপড়ের অভাবে বাইরে বের হতে পারছেন না, বের হলেও পাচ্ছেন না শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন। গ্রামাঞ্চলেও একই চিত্র। কৃষকরা শীতের প্রকোপ এড়িয়ে যেতে পারছেন না ফসলের ক্ষেতে, এর ফলে একদিকে যেমন ফসলের ক্ষতি হচ্ছে তেমনি আর্থিকভাবেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে শীত নিবারণ করতে শীতবস্ত্র ক্রয় এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এসব শীতার্তের অনেকেই সামান্য বস্ত্র পরিধানের মাধ্যমেও শীতের প্রকোপ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারছে না। বরং একই কাপড় পরিধান, অপরিষ্কার ও নোংরা পরিবেশে জরাজীর্ণ জীবনযাপনের ফলে অনেকেই বিভিন্ন ঠান্ডাজনিত অসুস্থতার কবলে পড়ছে।

এই করোনা সংকটে এসব বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন, ছিন্নমূল, দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো না হলে তাদের জীবন চরম বিপর্যস্ত হয়ে ওঠার পাশাপাশি মানবিকতারও বিপর্যয় ঘটবে বৈকি!

এমতাবস্থায় সমাজের প্রত্যেক সচেতন সামর্থ্যবানদের মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। প্রত্যেকে নিজ অবস্থান থেকে যতটুকু পারা যায় তাদেরকে সাহায্য করার চেষ্টা করতে হবে। শীতকালকে আমরা অনেকেই ফ্যাশনের ঋতু হিসেবে মনে করি। অনেকেরই দেহে শুধু শীত নিবারণ নয় বরং ফ্যাশনের জন্য প্রয়োজনের অধিক বস্ত্র দেহে নিত্যদিন শোভা পায়। একবার ভাবুন, তাকান আপনার চারপাশটায়। তাহলেই কেবল আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন, আপনার তথাকথিত সৌন্দর্য বিকাশে আপনার প্রয়োজনের অধিক বস্ত্রগুলো শীতার্ত এ অসহায় মানুষগুলোর কতটুকু কষ্টের লাঘব করতে পারে।

শীতার্ত এসব নিম্ন শ্রেণির লোকজন আমাদের মতোই মানুষ। সমাজে আমাদের মতোই তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। সামাজিক জীব হিসেবে একজন শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য। এই কর্তব্যের অবহেলা করে মানবিকতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানো আমাদের জন্য মোটেও মঙ্গলজনক হবে না।

একটি দেশের চালিকাশক্তি হচ্ছে তাদের শ্রমজীবী মানুষ। হতদরিদ্র কিংবা দারিদ্র্যের আবর্তনে ঘোরা মানুষগুলোকে মোটেই দেশের বোঝা কল্পনা করা যাবে না, বরং দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসব শ্রমজীবী মানুষের শ্রম ছাড়া কখনোই সম্ভব হয়ে উঠবে না। তাই দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা সরকার স্থির করেছে তা বাস্তবায়নে শুধু শ্রমের মূল্যায়ন নয়, পাশাপাশি দরিদ্র এসব শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কোনো মানুষ যেন না খেয়ে থাকে, সেটির পাশাপাশি কোনো মানুষের যেন দুর্যোগ মোকাবিলায় স্বপ্নভঙ্গ না হয়, সেটিও সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শীতার্ত এসব অসহায় মানুষ শীতের কুয়াশায় বিলীন হয়ে পথ হারিয়ে যেন বিপথে না যায় তা আমাদের প্রত্যেকেরই  খেয়াল রাখতে হবে।

রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকদের অবশ্য প্রাপ্য পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে বস্ত্র ও বাসস্থান হলো সামাজিক জীবনযাপনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশ নিম্নআয় থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, নিঃসন্দেহে তা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের এবং সফলতার স্মারকস্বরূপ। কিন্তু দেশ উন্নত হলেই যে দেশের সব নাগরিকের জীবনমান উন্নত হবে এমনটি নয়। তাই ধনী এবং দরিদ্র আমাদের সমাজে থাকবেই, থাকবে সাহায্যপ্রত্যাশী অসংখ্য মানুষও; আর এখানেই হবে আমাদের মানবিকতার পরীক্ষা। আর এতে উত্তীর্ণ হতে পারলেই কেবল এই দেশ সুখ-সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ সোনার বাংলা হয়ে উঠবে।

 

লেখক : গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১