বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১০ December ২০২০

টিভি বিজ্ঞাপন ও নারী


আধুনিক যুগে টেলিভিশন খুবই জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি গণমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনজীবনে প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে করপোরেট জগতেও টেলিভিশন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের প্রচার চালিয়ে থাকে। এসব বিজ্ঞাপনে নারীদের যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তার অধিকাংশই বেশ আপত্তিকর বটে। গণমাধ্যমে নারী-পুরুষের ভাবমূর্তি কীভাবে উপস্থাপন করা হবে, তার তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণের পদ্ধতিকে বলা হয় ‘জেন্ডার অ্যাডভারটাইজমেন্ট’। জেন্ডার অ্যাডভারটাইজমেন্টের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় দেখা যায় বিজ্ঞাপনগুলোতে নারীদের উপস্থাপন করা হচ্ছে মোহনীয়, অপরূপা, লোভী, সেবাদাসী, দুর্বল, যৌনবস্তু, পুরুষ-নির্ভর হিসেবে; বিপরীতক্রমে পুরুষদের উপস্থাপন করা হচ্ছে সাহসী, পুরুষালি, শক্তিশালী ও সিরিয়াস হিসেবে।

আমাদের দেশে একটি কথিত রং ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, গায়ের রং কালো তাই মেয়েটি ট্রেন মিস করছে— এ দৃশ্য স্বপ্নে দেখে ওই ক্রিম মাখার পর মেয়েটি সুন্দরী হয়ে যায়। এর পরের দৃশ্যে দেখা যায় মেয়েটিকে চলন্ত ট্রেনে তুলতে প্রতিটি দরজার কাছে ছেলেরা হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে এবং তাদের একজনের সহায়তায় সে ট্রেনে উঠে যায়। আবার অন্য একটি বিজ্ঞাপনে সুন্দরী হওয়ার জন্য সাত দিনের চ্যালেঞ্জ দেখানো হয়েছে। এ ধরনের প্রসাধন সামগ্রীর বিজ্ঞাপনগুলোতে আরো দেখানো হয়, কালো বর্ণের কারণে পাত্রপক্ষ মেয়েটিকে পছন্দ করে না। পাত্রপক্ষ মেয়েটিকে দেখতে এসে গায়ের রঙের জন্য তার ছোট বোন বা বান্ধবীকে পছন্দ করে। পরে মেয়েটি ওই প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করে ‘সুন্দর’ হয়ে গেলে তাকে পছন্দ হয়ে যায়। কী আশ্চর্য কেরামতি এসব সামগ্রীর! এখানে কৌতূহলী মনের জিজ্ঞাসা, এসব ত্বক-ফর্সাকারী ক্রিমের যদি এতই গুণাগুণ থাকে, তবে তারা আফ্রিকার কালো রঙের মানুষদের কাছে গিয়ে তাদের গায়ের রং সাদা করছে না কেন? আবার গাড়ির বিজ্ঞাপনে স্বল্পবসনা মডেলকে গাড়ির পাশে শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। খুব কম বিজ্ঞাপনেই মেয়েদের গাড়ি চালাতে দেখা যায়। পুরুষদের পারফিউমের বিজ্ঞাপনে দেখা যায় শুধু ওই পারফিউম লাগানোর কারণে মেয়েটি এক পুরুষের কাছ থেকে অন্য পুরুষের কাছে চলে যাচ্ছে। কনডমের বিজ্ঞাপনগুলো তো আরো মারাত্মক।

রং ফর্সাকারী ক্রিম কিংবা সুগন্ধি তেলের বিজ্ঞাপনে বৃষ্টির বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হলেও সেই বৃষ্টিতে ওই নারী মডেলটির সাদা শিফন বা জর্জেটের শাড়ি পরে ভিজতেই হবে— এটা কতটুকু প্রাসঙ্গিক? নুডুলস, অলংকার, আইসক্রিম, জুস, সয়াবিন তেল, জামাকাপড়ের বিজ্ঞাপন— সবকিছুতেই মডেল মেয়েরা। এ ধরনের বিজ্ঞাপনে রং ফর্সাকারী ক্রিম মেখে বিশ্বজয় করা কিংবা তেল দিয়ে রান্না করে স্বামীর মন জয় করায় মত্ত নারীরা। ওয়াশিং পাউডার, হারপিক, ডিশ ওয়াশিং পাউডার কিংবা সাবানের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কাপড় ধোয়া এবং রূপ ফুটিয়ে ছেলেদের মন জয় করাই যেন মেয়েদের কাজ। মূলত এভাবে টেলিভিশনে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে নারীকে হেয় করা হচ্ছে।

সিগমুন্ড ফ্রয়েডের তত্ত্বানুসারে মানুষের মনে তিনটি স্তর রয়েছে— চেতন, প্রাকচেতন এবং অবচেতন। এর মধ্যে অবচেতন অংশ আমাদের মনের দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে বিদ্যমান। চেতন মন যখন এসব বিজ্ঞাপনের মোহজালে আবদ্ধ হয়, তখন এর অন্তর্নিহিত বিষয়গুলো অবচেতন মনে সুকৌশলে প্রবেশ করে— কমবয়সি থাকতে হবে, চুল হতে হবে রেশম-কালো, চেহারা হতে হবে ফর্সা, সাদা মানেই সৌন্দর্য, তাই সাদা হওয়ার জন্য ভালো ব্র্যান্ডের মেকআপ ব্যবহার করতে হবে ইত্যাদি। শিশু-কিশোরদের অনেক মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রম করতে হয়। নানারকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে কিশোরীরা এসব বিজ্ঞাপন দেখে প্রভাবিত হতে পারে। তার মনে এসব করপোরেট-দুনিয়া বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে একটা মিথ্যে শরীরের প্রতিচ্ছবি তৈরি করে, যেখানে তাকে বোঝাতে থাকে দেহ হতে হবে মডেলদের মতো অতীব শুভ্র ও সুন্দর, যেখানে কোনো দাগ থাকা যাবে না।

এরকম একটা কাল্পনিক প্রতিচ্ছবি তৈরি করে কিশোরীদের স্বাভাবিক মানসিক অবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। একটা শিশু যখন এসব বিজ্ঞাপন দেখে দেখে বড় হতে থাকে, তখন তার অবচেতন মনে থাকা এসব বিষাক্ত বিষয়গুলোকে সে বাস্তব হিসেবে মেনে নেয়। সে এসবের মাধ্যমে পুরুষালি ও মেয়েলি কাজের মানদণ্ড নির্ণয়ে অবতীর্ণ হয় এবং এভাবে সমাজে লৈঙ্গিক বৈষম্যও সৃষ্টি হয়।

লেখক :সিদ্ধার্থ সজল

শিক্ষার্থী, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১