আপডেট : ০৮ December ২০২০
বাংলাদেশের পবিত্র জাতীয় সংসদের একজন জনপ্রতিনিধি আন্তর্জাতিক অপরাধী হিসেবে প্রকাশ পাবে এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। সারা বিশ্ব যখন মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত তথা কঠোর অবস্থানে, এমন সময়ে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ওরফে পাপুলকে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ কুয়েতে আটকের ঘটনা অনভিপ্রেত, লজ্জা ও দুর্ভাগ্যজনক। একজন জনপ্রতিনিধি (আইনপ্রণেতা) আর অন্য কেউ গ্রেপ্তার হওয়া এক নয়। আমাদের দেশের চোর-ডাকাতদের নানা কুকীর্তির অর্জন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি ও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে! সংসদের একজন জনপ্রতিনিধি তথা আইনপ্রণেতার এমন অধঃপতিত হওয়া রাষ্ট্রীয় চরিত্রের অসুস্থতার বহিঃপ্রকাশ। সম্ভবত এই ধরনের ঘটনা আমাদের দেশে প্রথম। দেশের একজন সংসদ সদস্য অন্য দেশের কারাগারে বন্দি থাকা বাংলাদেশের জন্য খুবই লজ্জাজনক বিষয়। দেশের আইনপ্রণেতা হয়ে বিদেশে অর্থ ও মানব পাচারের অপরাধে জেলে থাকার পরও আমাদেরকে শুনতে হয়, সে এখনো বাংলাদেশের সংসদ সদস্য! বিদেশে লাভজনক প্রতিষ্ঠান গড়ে, সেখানে পদ-পদবি নিয়ে বছরব্যাপী বিদেশে থেকে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন কতটুকু আইনসম্মত? মাননীয় স্পিকারকে এদের সংসদ সদস্য পদ স্থগিত রেখে বাকি সংসদ সদস্যদের মান রক্ষা করা জরুরি বলে আমরা মনে করি। কুয়েত যেখানে নিজের দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ছাড় দিচ্ছে না, সেখানে বাংলাদেশের এই সংসদ সদস্যকে একচুলও ছাড় দেবে বলে মনে হয় না। আমরা মনে করি কালবিলম্ব না করে সংসদ সদস্য দম্পতির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা এবং সংসদের এথিকস কমিটি যদি অভিযোগের ব্যাপারে নিশ্চিত হয় তবে সংসদের অবমাননার জন্য তাদের বহিষ্কার করা। কুয়েতের একটি ফৌজদারি আইনি পরামর্শক সংস্থার দুই আইনজীবী গণমাধ্যমকে বলেন, এমপি শহিদের খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে হয়। ওই দুই আইনজীবী জানান, কুয়েতের মানব পাচারবিরোধী আইন অনুযায়ী, অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১৫ বছর শাস্তির বিধান আছে। সংসদ সদস্য শহিদের বিরুদ্ধে অবশ্য ভুয়া ভিসায় শ্রমিক পাচার ও নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে। এ ছাড়া কুয়েতের আইন অনুযায়ী অবৈধ মুদ্রা পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হলে ৫০ হাজার কুয়েতি দিনার থেকে ১০ লাখ কুয়েতি দিনার (এক দিনারে ২৭৫ টাকা ৫০ পয়সা) জরিমানার বিধানও আছে। একই অপরাধে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০১৬ সালে রাজ্যসভার এথিকস কমিটির সিদ্ধান্তে শহিদের চেয়েও বড় শিল্পপতি বিজয় মালিয়াকে রাজ্যসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ভারতের যে এথিকস কমিটি বিজয়ের বিরুদ্ধে বহিষ্কারের সুপারিশ করেছিল, তার থেকে শহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক গুরুতর বলে জানা যায়। বাংলাদেশ সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের আওতায় স্পিকারকে বিচার বিভাগীয় এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। এ এখতিয়ারের ফলে স্পিকার কোনো নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যে কোনো সংসদ সদস্যের ‘যোগ্যতা’ পরখ করার এখতিয়ার রাখেন। স্পিকার সংসদ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত বা বহিষ্কার করতে পারেন। এ জন্য তাকে অন্য কোনো সংস্থার মুখাপেক্ষী বা কারো চূড়ান্ত রায় বা সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। এমনকি স্পিকারকে সর্বোচ্চ আদালতের মুখাপেক্ষী থাকতে হবে না। ভারতে অর্থের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন তোলার দায়ে ২০০৬ সালে ১১ সংসদ সদস্য (১০ জন লোকসভার, ১ রাজ্যসভার) বহিষ্কৃত হন। ভারতে ওই ১১ জন বহিষ্কৃত সংসদ সদস্যের মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গোটা বিষয়টি নিরঙ্কুশভাবে হাউস অব কমন্সের নজিরের আলোকে বিচার করেন এবং রায় দেন যে, কোনো সংসদ সদস্যের ‘যোগ্যতা’ যাচাই করে পদক্ষেপ নেওয়ার এখতিয়ার স্পিকার সংরক্ষণ করেন। কারো বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির এখতিয়ার স্পিকারের আছে এবং সেখানে কোনো ভুলভ্রান্তির জন্য তিনি কোনো আদালতে জবাবদিহি করবেন না। শহিদুল ইসলাম ওরফে পাপুল এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে তার এলাকার অনেকেই তাকে চিনত না। নির্বাচনের কিছু দিন আগে থেকে এলাকায় তার আনাগোনা দেখা যায়। টাকার জোরে দুধের মাছির মতো জুড়ে বসেছেন। মূলত টাকার কাছে বিক্রি হয়েই জোটের প্রার্থীকে বিশেষ কৃপায় নিষ্ক্রিয় রেখে শহিদ এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখানেই এমপি শহিদুল থেমে থাকেননি। নিজের স্ত্রীর জন্যও সংরক্ষিত আসন থেকে এমপি পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। স্পষ্টতই দেশ এখন সৎ এবং যোগ্য নেতৃত্বের দেউলিয়াপনায় ভুগছে! এমপি শহিদের কারণে দেশের যে পরিমাণ ইমেজ ক্ষতি হয়েছে তার দায়ভার কে নেবে? প্রকৃত ত্যাগী রাজনীতিবিদ কিংবা শিক্ষিত ও ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিদের সাপোর্ট না দিয়ে, অগণতান্ত্রিক ধারার শহিদের মতো ব্যক্তিদের সুযোগ করে দিলে দেশের জন্য এরকম দুঃসংবাদ আসবেই। সুযোগসন্ধানীরা সব সময়ই ‘দুধের মাছির’ মতো ক্ষমতার আশপাশে ঘুরঘুর করে উড়ে বেড়ায়। সুযোগ বুঝে ক্ষমতার মধুতে চুমুক দিয়ে থাকে। ক্ষমতার আশপাশে এত বেশি দুধের মাছিদের ভিড় থাকে যে, দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতারাও তাদের সামনে দাঁড়াতে পারেন না। এই সুযোগসন্ধানী লোকগুলো ঝোপ বুঝে কোপ মারায় দারুণ সিদ্ধহস্ত। সংসদ থেকে শহিদকে বহিষ্কার কিংবা তার স্ত্রীকেও বহিষ্কার করলেও দেশের যে সম্মানহানি হয়েছে সেটা কি ফিরে আসবে? যারা শহিদের মতো লোককে নির্বাচনের জন্য ‘বিশেষ বিবেচনায়’ যোগ্য ঘোষণা করেছিল তারা কি এর দায়ভার নেবে? কুয়েতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তরা কী করছেন? রাষ্ট্রের এমন স্পর্শকাতর ইস্যুতে কুয়েত দূতাবাসের নিজস্ব তদন্ত করে নোট পাঠানো উচিত ছিল। দেশের একজন আইন প্রণেতার বিদেশের মাটিতে এভাবে গ্রেপ্তার হওয়াটা দেশের জন্য লজ্জাজনক, তাই এই কূটনৈতিক ব্যর্থতার জন্য ওই দেশের রাষ্ট্রদূতসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন আছে। স্বদেশের এমপিরা সে দেশে কি ব্যবসা করছেন তা কি দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানেন না? আমাদের দেশে যত মানব পাচার হয়, তার সাথে এসব রাজনৈতিক রাঘববোয়ালরাই জড়িত। এমনই একজন মানব পাচার ও শ্রমিক নির্যাতনকারী এবং ‘মিল্ক ফ্লাই’ সংসদ সদস্য শহিদ। যার মুখোশ ইতঃপূর্বে জাতির সামনে প্রকাশ হয়েছে। এমপি শহিদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার কোম্পানিতে চাকরি করা কুয়েত প্রবাসী এক শ্রমিক সোশ্যাল মিডিয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘৮ লক্ষ টাকা দিয়ে কুয়েতে এসেছি। কারণ আমার জন্ম বাংলাদেশ নামক প্রান্তে। ভারতীয়, পাকিস্তান কিংবা নেপালসহ অনান্য দেশের মানুষ পাসপোর্ট, ভিসা, বিমানের টিকিটসহ ১ লক্ষ টাকার চেয়েও কম খরচে বিদেশে আসে। এটা কোনো আষাঢ়ে গপ্প নয়।’ অথচ আমাদের দেশে কুয়েত, সৌদি, কাতার কিংবা আমিরাতে শ্রমিক পাঠাতে ৬ থেকে ৮ লক্ষ টাকার অধিক নেওয়া হয়। এর জন্য দায়ী পুরো সিস্টেমের দুর্নীতি। যার ভাগ সবাই পায়। যে কারণে আমাদের শ্রমিকরা অতিরিক্ত চাপে থাকে। অন্তত দুই বছর লাগে টাকা তুলতে পারে না। চুক্তি শেষ হওয়াতে তিন বছরের মাথায় খালি হাতে ফেরত আসতে বাধ্য হয়। কুয়েতের জেলহাজতে থাকা কাজী শহিদ দেশটিতে ব্যবসা পরিচালনায় সেখানকার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে ঘুষ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। যার ভিত্তিতে তাদের তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে কাজী শহিদের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মুর্তজা মামুনকে। কুয়েতের তদন্ত কর্মকর্তারা সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মুদ্রা পাচারের প্রমাণও পেয়েছেন। কুয়েতের গণমাধ্যমগুলো সংসদ সদস্য শহিদকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তদন্তের সঙ্গে যুক্ত সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে ‘আরব টাইমস’-এর এক খবরে বলা হয়েছে, ভিসা-বাণিজ্যের নামে নির্বিঘ্নে মানব পাচারের জন্য নগদ ও চেকের মাধ্যমে টাকা দেওয়ার পাশাপাশি কুয়েতের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন কাজী শহিদ। এসব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি বছর তার গড় লাভ ছিল ২০ লাখ দিনার (এক দিনারে ২৭৫ টাকা ৮৮ পয়সা হিসাবে সাড়ে ৫৫ কোটি টাকার বেশি)। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে সংসদ সদস্য শহিদের মতো অনৈতিক সুবিধাবাদীরা ক্ষমতাসীনদের বৃত্তেই বিচরণ করবে এটাই সত্য। আর ক্ষমাতাসীনদের কিছু নেতা বুঝে না বুঝে এই সুবিধাভোগীদের আশ্রয় দিচ্ছেন। যার কারণে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বরাবরই ক্ষমতাসীনদের আশপাশে সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগীদের একটি বৃত্ত গড়ে ওঠে। সুবিধাবাদী, সুবিধাভোগী ও জালিয়াতিকারীদের আপন করে সর্বোচ্চ সেবা-যত্ন করেছেন তার প্রমাণ সংসদ সদস্য শহিদের স্ত্রীর সংরক্ষিত আসনে এমপি হওয়া। সরকার ক্ষমতায় থাকলে এ রকম অনুপ্রবেশ হয়েই থাকে। সরকারের মধ্যে স্বদলীয় কিছু লোক এদের জায়গা করে দিয়ে থাকে। ফলস্বরূপ, তারা দ্রুত একটি দাপুটে অবস্থা তৈরি করে ফেলে। আওয়ামী লীগ একটি বিশাল দল। এ জাতীয় ষড়যন্ত্রকারী, প্রতারক, লোভী মানুষ শাসক দলে আশ্রয় পেতে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে থাকে, তাদের ধরা পড়তে হয়। বর্তমান সরকার যে দুর্বৃত্তায়ন রাজনীতি বরদাশত করে না শহিদের গ্রেপ্তার ও সম্প্রতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনা তারই প্রমাণ।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১