বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০৯ November ২০২০

আধুনিক বরিশালের নির্মাতা মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত


এম এ জলিল

 

 

অশ্বিনী কুমার দত্ত বরিশালের নির্মাতা। তিনি স্বদেশী যুগে ভারত উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন। সাধনা, নিষ্ঠা, মানবপ্রেম ও স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক। এ সিদ্ধ পুরুষের জন্ম বরিশালে। বরিশালের একান্ত আপনজন অশ্বিনী কুমার দত্ত। তিনি বরিশালের গৌরব। বরিশালের পরিচয় মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত ও শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক। তারা বরিশাল তথা বাংলার কৃতী সন্তান। বাংলার রাজনীতিতে তারা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী জননেতা। তারা উভয়ে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। বঙ্গভঙ্গ থেকে স্বদেশী, স্বদেশী থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে অশ্বিনী কুমার দত্ত বাঙালি জাতির কাছে চির পূজনীয় ও স্মরণীয়। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের একান্ত ভক্ত ছিলেন উপমহাদেশের দুই কৃতিমান পুরুষ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও শেরেবাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক। তার ও তার দুই অনুসারী চিত্তরঞ্জন দাস ও শেরেবাংলার মহান কৃতিত্বের অনুসারীরা ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন জুগিয়েছিলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে এই দুই নেতার ভক্তকুলেরা। ১৯৭১ সালে ভারত বাঙালিদের আশ্রয় দিয়েছে, সমর্থন জুগিয়েছে। সে কারণে বাংলাদেশ ৯ মাসের মধ্যে স্বাধীনতা লাভ করে।

অশ্বিনী কুমার দত্ত ১৯৫৬ সালের ২৫ জানুয়ারি পটুয়াখালী জেলার লাউকাটিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ব্রজমোহন দত্ত তখন পটুয়াখালীর মুন্সেফ ম্যাজিস্ট্রেট। পিতা-মাতার ধর্মানুরাগ অশ্বিনী কুমারের ওপর বাল্যকালে প্রভাব বিস্তার করে। বাটাজোর গ্রামে নিজ বাড়িতে জমিদারির গোমস্তা নীল কমল সরকারের কাছে তালপাতায় বর্ণমালা শিক্ষালাভ করেন। তারপর পিতার সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যাশিক্ষা লাভ করেন। তিনি বিষ্ণুপুর ও রংপুরে নিম্নশ্রেণিতে পড়েন। ১৮৬৯ সালে বিএ পড়ার সময় তিনি নলছিটির নথুল্লাবাদের মলিবহর পরিবারের কায়স্থকন্যা ৯ বছর ৪ মাস বয়সের সরলা বালাকে বিয়ে করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার সময় তার বয়স ১৪ বছরের কম ছিল। কিন্তু পরীক্ষার সময় বাড়িয়ে লেখা হয়। এ মিথ্যা সংশোধনের জন্য তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে চতুর্থ বর্ষে উন্নীত হয়ে পড়া স্থগিত রেখে যশোরে পিতার কাছে চলে আসেন। তিনি পিতার কাছে ধর্মচর্চা, সংস্কৃত ও ফার্সি শিক্ষালাভ করেন। এরপর এলাহাবাদে কিছুদিন ওকালতি করেন। পুনরায় তিনি ১৮৭৬ সালে বিএল পাস করেন। অশ্বিনী কুমার কলকাতায় ছাত্রজীবনে রামতনু লাহিড়ী, রাজনারায়ণ বসু, কেশব চন্দ্র, রামকৃষ্ণ পরমহংস ও স্বামী বিবেকানন্দের সংস্পর্শ লাভ করে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষালাভ করেন। রাজানারায়ণ তাকে বলেছিলেন, অশ্বিনী যদি কাজ করিতে চাও বরিশালে থাকিও, আর যদি সুনাম করিতে চাও কলিকাতায় থাকিও। পিতা ব্রজমোহন দত্ত পুত্রের ইংরেজদের গোলাম হওয়া পছন্দ করতেন না। তাই পিতার নির্দেশ ও রাজনারায়ণের উপদেশে তিনি ১৮৮২ সালে বরিশাল জজ কোর্টে ওকালতি শুরু করেন। বরিশালে তিনি প্রথম এমও, বিএল। অচিরেই তিনি একজন সৎ ও ন্যায়বান উকিল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি বরিশালে সমাজের কুসংস্কার ও সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি ব্রহ্ম সমাজের সদস্য হন এবং পুনরায় সমাজের চাপে সনাতন ধর্মে ফিরে যান। বাজার রোডের কালীবাড়ীর সোনা ঠাকুরকে তিনি পরম শ্রদ্ধা করতেন।

অশ্বিনী কুমার সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারের কর্মসূচি একই সঙ্গে গ্রহণ করেন। তিনি ১৮৮৪ সালের ২৭ জুন বিএম স্কুল এবং ১৮৮৯ সালের ১৪ জুন বিএম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিএম স্কুল ও কলেজে ১৭ বছর শিক্ষকতা করেন। তিনি কোনো বেতন নিতেন না। অধিকন্তু বিদ্যালয়ের জন্য ৩৫ হাজার টাকা দান করেন। তিনি ১৮৮৬ সালে কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৮৮৭ সালে বরিশালে লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং ১৮৯৭-১৯০০ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯০৫ সালে তিনি বরিশালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু করেন। ১৯০৬ সালে বরিশালে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস প্রাদেশিক সম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি স্বদেশ বান্ধব সমিতি গঠন করে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন করেন। তার পরিচালিত স্বদেশী আন্দোলন সারা ভারতে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং তাকে ১৯০৮ সালে সরকার গ্রেপ্তার করে রেঙ্গুন ও আগ্রায় অন্তরীণ রাখে। ১৯১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তিলাভ করে বরিশালে আসেন। মুক্তিলাভের পর তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। তিনি বহুমূত্র ও উৎকট পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন। অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি কয়েকবার কংগ্রেসের সম্মেলনে যোগ দেন। তিনি শেষবারের মতো ১৯২১ সালে বরিশালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। ১৯২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর মহাত্মা গান্ধী ও মওলানা মুহম্মদ আলী অশ্বিনী কুমারের সঙ্গে তার বাসায় সাক্ষাৎ করেন। তিনি রোগমুক্তির জন্য ১৯১০ সালে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন। কিন্তু তার রোগের কোনো উপশম হয়নি। তিনি শেষবারের মতো ১৯২২ সালের আগস্ট মাসে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গমন করেন। সেখানে তিনি এক বছর তিন মাস ছিলেন। মৃত্যুর আগে ভবানীপুরে ৫৯ নং চক্রবেড়ে রোড বাড়িতে ছিলেন। ১৯২৩ সালের ৭ নভেম্বর বাংলা ১৩০০ সালের ২১ কার্তিক বুধবার বিকাল ৩টা ৫ মিনিটে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ওইদিন রাত ৯টা ৩০ মিনিটে কেওড়াতলায় তার দেহ সমাহিত করা হয়।

অশ্বিনী কুমার একজন প্রতিভাশীল সাহিত্যিক ছিলেন। ১৮৮৭ সালে বিএম স্কুলে ভক্তিতত্ত্ব সম্পর্কে কয়েকটি বক্তৃতা দেন এবং তা অবলম্বন করে ‘ভক্তিযোগ’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ভক্তিযোগ ইংরেজি ও ভারতের কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়। তার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কর্মযোগ’। ১৮৯৩ সালে তিনি স্বদেশ বান্ধব সমিতিতে তিনটি বক্তৃতা দেন এবং তা পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। ধর্মরক্ষিনী সভায় তার প্রদত্ত ভাষণ অবলম্বনে দুর্গোৎসব তত্ত্ব প্রকাশিত হয়। তিনি কতগুলো সংগীত রচনা করেন এবং তা ভারতগীতি নামে প্রকাশিত হয়। তিনি সংবাদপত্রের সেবক ছিলেন। তার প্রেরণায় ‘বরিশাল হিতৈষী’ ও ‘বিকাশ পত্রিকা’ প্রকাশিত হয়। দুর্গামোহন সেন ‘বরিশাল হিতৈষী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

অশ্বিনী কুমার একজন শিক্ষক, সমাজ সংস্কারক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, জননেতা তোফায়েল আহমেদ, সওগাতুল আলম সগীর, আশমত আলী সিকদার ও ইতিহাসবিদ সিরাজ উদ্দীন আহমেদ।

 

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১