বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০২ November ২০২০

আর্সেনিক : এক নীরব ঘাতক


মু. সায়েম আহমাদ

 

 

পানির অপর নাম জীবন। পানি মানুষের জীবনের জন্য আবশ্যক। পানি ছাড়া আমাদের জীবন অচল। দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানান কাজে পানি ব্যবহার করি। পানি আমাদের তৃষ্ণা মিটাতে এবং রান্নার কাজে ব্যবহূত হয়। গ্রামাঞ্চলে বাড়ির পাশের নলকূপের পানি সাধারণত নিরাপদ মনে করেই মানুষ পানি পান করে। আর সেই পানিতে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক রয়েছে কি না পরীক্ষা না করে বোঝার উপায় নেই। আর্সেনিক মূলত এক প্রকার রাসায়নিক উপাদান। পানিতে স্বল্পমাত্রায় আর্সেনিক সব সময় থাকে। কিন্তু যখনই এর মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায় তখনই ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা ০.০১ মিলিগ্রাম এবং বাংলাদেশে পানির সহনীয় মাত্রা ০.০৫ মিলিগ্রাম। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশে আর্সেনিকের মাত্রা অনেক বেশি। বর্তমানে আমাদের দেশে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে প্রায় দুই কোটি মানুষ। আমাদের দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে প্রায় ৫৪ জেলায় নলকূপের পানিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া গেছে। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলায় নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি খুবই কম। ২০০৩ সালে দেশের ২৯% নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া যায়। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত এই দেশে আর কোনো সমীক্ষা হয়নি।

২০১৬  সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘গণবিষের’ উদাহরণ বাংলাদেশের আর্সেনিক পরিস্থিতি। বাংলাদেশে প্রতি বছর আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার কারণে ৪৩ হাজার মানুষ মারা যায়। তবে এ তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু আর্সেনিকের কারণে বছরে কত মানুষের মৃত্যু হয় তার কোনো পরিসংখ্যান এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিতে পারেনি। ২০১২ সালে সরকার একটি জরিপ করেছিল। তখন ৬৫ হাজার ৯১০ জন আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল। এরপর আর্সেনিক সমস্যার সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। বরং দিন দিন এই নীরব ঘাতকের তৎপরতা বেড়ে চলছে, যা আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। আর্সেনিক দূষিত হয় মূলত প্রাকৃতিক কারণে। মাটির নিচে আর্সেনিকের খনিজ থাকে। এই খনিজ ভূগর্ভের পানির স্তরের সংস্পর্শে এলে তা পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করে। এ ছাড়া আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদনের জন্য রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। ফলে বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে দূষিত করছে নদী, নালা, খাল-বিল এবং সমুদ্রের পানি। এই অধিকমাত্রায় রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার আর্সেনিক দূষণের অন্যতম কারণ।

আর্সেনিক বিষক্রিয়া তাৎক্ষণিক বোঝা যায় না। সেটা বোঝা যায় কয়েক বছর পর। আর্সেনিকযুক্ত পানি দীর্ঘদিন পান করলে ধীরে ধীরে আমাদের শরীরে নানারকম রোগের উপসর্গ তৈরি করে। আর্সেনিকের কোনো গন্ধও নেই। তাই আমরা সহজে তা উপলব্ধি করতে পারি না। একপর্যায়ে এসে আমরা লক্ষ করতে পারি হাতে-পায়ে এক ধরনের ক্ষত বা ঘা দেখা দেয়, যা আর্সেনিকোসিস রোগ নামে পরিচিত। আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর জিহ্বা, মাড়ি, ঠোঁটে লাল ভাব দেখা দেয় এবং ক্ষুধামন্দা, অরুচি, বমি বমি ভাব হয়। এমনকি ক্যানসারের মতো ভয়াবহ রোগ হতে পারে। যার ফলে মৃত্যু পর্যন্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আর্সেনিকদূষণ সমাধানে চাই সরকারের কঠোর পদক্ষেপ। আর সেই পদক্ষেপগুলো বাস্তবে রূপান্তরিত করে আর্সেনিক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে।

গভীর নলকূপের পানি খাবার এবং রান্নার কাজে ব্যবহার করতে হবে। বৃষ্টির পানিতে আর্সেনিক থাকার আশঙ্কা নেই। তাই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করা জরুরি বলে মনে করছি। গ্রামাঞ্চলে পুকুরের পানি ফুটিয়ে ব্যবহার করা আবশ্যক। নলকূপের পানি পরীক্ষা করে ব্যবহার করতে হবে এবং আর্সেনিকযুক্ত নলকূপগুলো লাল রং লাগিয়ে চিহ্নিত করে দিতে হবে। যাতে করে সবাই সচেতন থাকতে পারে এই নীরব ঘাতক আর্সেনিক থেকে। রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে আর্সেনিক সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে এবং আর্সেনিকের কারণে কী কী ক্ষতি হতে পারে তা উপস্থাপন করতে হবে। আর এভাবেই নীরব ঘাতক আর্সেনিক সম্বন্ধে জনগণকে জানাতে হবে এবং তাহলেই কেবল সাধারণ মানুষ সচেতন হবে।

সুতরাং পরিশেষে বলতে চাই, আর্সেনিক রোগ কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। অতএব একজন থেকে অন্যজনে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। এটি কেবল খাবারের পানির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাই জনগণকে অধিক সচেতন হতে হবে এবং নিরাপদ পানি গ্রহণ করতে হবে। যেসব এলাকায় আর্সেনিকের মাত্রা বেশি, সেসব আক্রান্ত এলাকায় সরকারকে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করতে হবে। আর এর মাধ্যমেই শুধু সম্ভব এই ক্যানসারতুল্য নীরব ঘাতক আর্সেনিক থেকে রেহাই পাওয়া। মনে রাখতে হবে, সুন্দর ও সুস্থ জীবন আমাদের সবার কাম্য।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১