আপডেট : ০২ March ২০২০
পাবনার চাটমোহরসহ চলনবিলের ১৬টি নদী এখন মৎস্য খামার ও ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের প্রায় সকল নৌপথ এখন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে ব্যবসা-বানিজ্য ও কৃষিকাজে বিরুপ প্রভাব পড়েছে। কালের বিবর্তনে শত বছরের ঐতিহ্যধারী চলনবিল আজ মরা বিলে রূপান্তরিত হচ্ছে। মহাসড়ক নির্মাণ, অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, কালভার্ট, স্লুইচগেট, ক্রসবাঁধ ও দখল-দুষণসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কারণে ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে এ বিল। শুকিয়ে গেছে প্রবাহিত নদীগুলো। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও নানা প্রতিকুল পরিবেশের কারণে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে এর আয়তন। বিলের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর জেলার ১৬টি নদী করতোয়া, ইছামতি, গুমানী, গোমতী, আত্রাই, ভদ্রাবতী, গোহালা, বড়াল, নন্দকুজা, গাড়াদহ, কাকন-কানেশ্বরী, স্বরসতী, মুক্তাহার, গোহালা, ঝবঝবিয়া, ফুলজোড় নদী ছিল চলনবিলের প্রাণ, কিন্তু ধীরে ধীরে এসব নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে বিলুপ্তির পথে চলনবিলের দেশিও প্রজাতির মৎস্য সম্পদ। একসময় বিলের মাছ দেশর চাহিদা মিটিয়েও ভারতে রপ্তানি করা হতো। অন্যদিকে প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসীরা জাল দলিল তৈরী করে দখলে নিয়েছে কয়েক হাজার একর জমি। উপজেলা ভুমি অফিসের রেকর্ড থেকে জানা গেছে, চলনবিলের ১০টি উপজেলার আবাদ যোগ্য বেশির ভাগ খাস জমি ও জলাশয় এখন প্রভাশালীদের দখলে। নদীগুলোতে এখন আবাদ হচ্ছে বোরো, গমসহ নানা ফসলের। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গঠনকালে চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১ হাজার ৮বর্গ কি: মি:। এই বিলে রয়েছে ৩৯টি উপ বিল, ৪ হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ছোট-বড় ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি খাল। ২২টি খালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-নিমাইচড়া খাল, নবীর হাজির জোলা, বেশানীর খাল, হক সাহেবের খাল, উলিপুর খাল, গুমানী খাল, কুমারভাঙ্গা খাল, গাড়াবাড়ি খাল, জানিগাছার জোলা, কিনু সরকারের ধর ও সাত্তার সাহেবের খাল। এগুলো এখন মৎস্য খামারে পরিণত হয়েছে। ১৯৬৭ সালে চলনবিলের ইতিকথা বইতে এমএ হামিদ টি কে লিখেছেন, ১৯২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ছিল ৫শ’ বর্গমাইলের উপরে। ১৯০৯ ইং সালে চলনবিল জরিপ কমিটির রিপোর্টে উল্লেখিত তৎকালে বিলের আয়তন ছিল ১৪২ বর্গমাইল। এরমধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকা সারা বছর পানি জমে থাকতো। ওই রিপোর্টে বলা হয়, চলনবিল তার জলশ্রোতধারা ও নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। বর্তমানে বর্ষা মৌসুমে এর আয়তন দাঁড়ায় মাত্র ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে মূল বিলটির আয়তন দাঁড়ায় ১৫.৯ থেকে ৩১ কি. মি.। এছাড়া বিলের গভীরতা ১.৫৩ মিটার থেকে ১.৮৩ মিটার। প্রতি বছর চলনবিলের আয়তন হ্রাস পাচ্ছে। বাড়ছে ফসলী জমি। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র। ২৫ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এসব নদ-নদীতে বছর জুড়েই ৬-১২ ফুট পানি থাকত। ফলে সারাবছরই নৌচলাচল করত। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী ভরাট হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ, ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব ও ১৯৮০’র দশকে পদ্মার উৎমুখে অপরিকল্পিত স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে চলনবিলের বিভিন্ন নদ-নদী ও বিল, জলাশয়, খালগুলো পলি জমে ক্রমে ভরাট হয়ে গেছে। এ ছাড়া বিলের মাঝ দিয়ে যথেচ্ছভাবে সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট, নদী দখল করে বসতি ও দোকানপাট স্থাপন করায় নদীগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ১৯০৯ সালের পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের এক জরিপে দেখা গেছে, ১৯১৪ সালে বৃটিশ আমলে সিরাজগঞ্জ হতে পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের ফলে বিলের অপেক্ষাকৃত উঁচু উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে ভাটা পড়ে। এরপর থেকেই চলনবিলের আয়তন সংকীর্ণ হতে শুরু করে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এছাড়া পদ্মার পলি জমে গত কয়েক দশকে বিলের দক্ষিণাংশের প্রায় ২১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা শুকিয়ে গেছে। চলতি দশকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়ক নির্মাণের পর পানি প্রবাহে আরও বেশি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ফলে বিলের দেশীয় প্রজাতির প্রায় ৫০ প্রকার মাছের অধিকাংশরই বিলুপ্তি ঘটেছে। বিলুপ্ত প্রায় এসব মাছের মধ্যে রয়েছে কই, শিং, মাগুর, কাঁকিলা, শোল, বোয়াল, চিতল, মোয়া, হিজল, তমাল, জারুল বাতাসি, টেংরা, গোলসা, নন্দই, পুটি, সরপুটি, খলিশা, চেলা, ডানকানা, টাকি, বাইটকা, বাউস, কালোবাউস, চ্যাকা, বাইম, বউমাছ, গোঁচৌ, গোরপুইয়া, কুচিয়া, কচ্ছপ, কাছিম ও কাঁকড়া ইত্যাদি। প্রবিনরা বলেন, মাছ আর পানি যেন ছিল সমান সমান। এছাড়া বর্ষা মৌসুমে হাজার হাজার নারী পুরুষ শ্রমিক শুটকি উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু শুটকি সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় বর্তমানে এর উৎপাদনও কমে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানায়, গত ২৫ বছরে চলনবিলের গভীরতা কমেছে ৩ থেকে ৫ ফুট। অন্যদিকে চলনবিলের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত নদী ও খালগুলো ভরাট এবং নদীর উৎসমুখ বন্ধ করে দেয়ায় বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বিস্তৃত চলনবিলের বুকে ও নদীর তলদেশে এখন চাষ হচ্ছে ধান, গম, ভুট্টা, সরিষাসহ নানা জাতের সবজি, মশলা, রসুন পিঁয়াজ। বিলে বর্তমানে ফসলি জমির পরিমাণ ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৩৫ হেক্টর। এ সকল জমিতে চাষের জন্য অনেক গভীরতা করে শ্যালো মেশিন বসিয়েই ঠিকমতো পানি পাওয়া যাচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। আবার এতোদিন যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত তারাও এখন পেশা পরিবর্তন করে ফসলের মাঠে কাজ করছে। বাংলাদেশ সরকারের চলনবিল মৎস্য প্রকল্প থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী- ১৯৮২ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে এক সমীক্ষায় দেখা যায় ১৯৮২ সালে মোট ১ লক্ষ ৭৭ হাজার ৬১ জন জেলে এসব নদ-নদী ও খাল জলাশয়ে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। পর্যায়ক্রমে কমতে কমতে ২০০৬ সালে এর সংখ্যা ৭৫ হাজারে দাঁড়ায়। চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান বলছেন, “চলনবিলকে রক্ষা করতে হলে যমুনা ও পদ্মা নদীসহ বিলের প্রধান প্রধান সব নদী ও খাল ড্রেজিংয়ের আওতায় এনে পানির প্রবাহ সৃষ্টি ও ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। নদী দখল বন্ধ ও বেদখল হওয়া জায়গা উদ্ধার করতে হবে। জনগনের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বিলের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সব ব্রিজ, কালভার্ট, ক্রসবাঁধ, স্লুইচগেট, অপসারণ করতে হবে। তাই ঐতিহ্যবাহী এই বিলের নদী-উপনদীগুলো রক্ষায় আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে ভবিষ্যতে এর অস্তিত্ব থাকবে না বলে আশংকা করা হচ্ছে। তিনি মনে করেন, চলনবিল রক্ষায় এখন প্রয়োজন পরিবেশগত বিপর্যয়ের মাত্রা ও বিস্তৃতি পর্যবেক্ষণ, সার্বিক অবস্থার মূল্যায়ন ও করণীয় নির্ধারণ। এলাকার সচেতন মহল মনে করেন, চলনবিল ও এর উপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোকে রক্ষা করতে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। নইলে ভবিষ্যতে এ অঞ্চল মরুভুমিতে পরিণত হবে।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১