আপডেট : ০১ March ২০২০
শুষ্ক মৌসুমেও মেঘনার তীব্র ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চারটি ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রাম। করালগ্রাসী মেঘনা ইতোমধ্যে গিলে খেয়েছে ওইসব গ্রামের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা। ভাঙনকবলিত গ্রামগুলো হচ্ছে, উপজেলার চরকালকিনি ইউনিয়নের নাছিরগঞ্জ ও হাজীগঞ্জ, সাহেবেরহাট ইউনিয়নের কাদিরপন্ডিতেরহাট, চরফলকন ইউনিয়নের লুধুয়া ফলকন এবং পাটারীরহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ চরফলকন। ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন ওইসব গ্রামের বাসিন্দারা। এর ফলে শুষ্ক মৌসুমেই তারা ভাঙনরোধে প্রস্তাবিত প্রকল্পের অনুমোদনসহ অর্থছাড়ের দাবি জানান। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শুষ্ক মৌসুমেও মেঘনার তীরবর্তী ওইসব গ্রামগুলোতে তীব্র ভাঙন চলছে। ভাঙনের মুখে পড়ে নদীতে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি, বাড়িঘর, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট ও পুল-কালভার্টসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭০ সালের দিকে চরকালকিনি ও চরফলকন ইউনিয়ন দু’টিতে মেঘনার ভাঙন শুরু হয়। দীর্ঘ পাঁচ দশকে মেঘনার এ অব্যাহত ভাঙনে চরকালকিনি ইউনিয়নের চরকাঁকড়া, চরসামছুদ্দিন ও তালতলি, সাহেবেরহাট ইউনিয়নের চরজগবন্ধু, মাতাব্বরনগর এবং চরফলকন ইউনিয়নের চরকটোরিয়া, চরকৃষ্ণপুর, মাতাব্বরচর ও পাতারচর এবং পাটারীরহাট ইউনিয়নের উরিরচর, পশ্চিম চরফলকন ও ডিএস ফলকনসহ ১২টি গ্রাম সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এতে করে ওইসব গ্রামগুলোসহ বর্তমানে ভাঙনকবলিত পাঁচটি গ্রামের প্রায় অর্ধলাখ মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। এদের বেশীর ভাগই পার্শ্ববর্তী জেলা নোয়াখালী সদর, সুবর্ণচর, লক্ষ্মীপুর সদর ও কমলনগর উপজেলার চরকাদিরাসহ বিভিন্ন এলাকায় বাড়িঘর নির্মাণ করে কোনরকমে বসবাস করছেন। বাকিরা আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধের ওপর। যাদের অধিকাংশেরই এখন দিন কাটে অর্ধাহরে-অনাহারে। জানা গেছে, গত ৪৯ বছরের ভাঙনে মেঘনার গর্ভে বিলীন হয়েছে এসব এলাকার প্রায় ১৫ হাজার একর ফসলি জমি, সরকারি-বেসরকারি ১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, আশ্রয়ণ কেন্দ্রের পাঁচটি কলোনি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এবং কয়েক কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়কসহ অসংখ্য মসজিদ, বিভিন্ন স্থাপনা ও হাট-বাজার। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেঘনার এ ভাঙনরোধে স্থানীয় ভাবে একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা যেমন সফল হয়নি; তেমনি সরকারিভাবে নেওয়া উদ্যোগও দেখছে না সফলতার মুখ। ২০০৯ সালে প্রথমবার মহাজোট সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের প্রচেষ্টায় ‘মেঘনার ভাঙন থেকে রামগতি ও কমলনগরকে রক্ষায় নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটির আওতায় ২০১৪ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ১৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। প্রথম পর্যায়ের ওই অর্থ দিয়ে কমলনগর উপজেলার মাতাব্বরহাট এলাকায় এক কিলোমিটার ও রামগতি উপজেলায় সাড়ে চার কিলোমিটার এলাকায় ব্লকবাঁধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু কমলনগর উপজেলার অপর ১২ কিলোমিটার এলাকা অরক্ষিত থেকে যায়। ভাঙনের তাণ্ডবলীলা চলতে থাকায় গেল বর্ষা মৌসুমে লুধুয়া ফলকন এলাকায় আপদকালীন কাজের অংশ হিসেবে প্রায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হয়। কিন্তু ভাঙনের তীব্রতায় তাও নদীতে বিলীন হওয়ার পথে। এখন তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থ ছাড় না হওয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন প্রতিরোধে যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারছে না। যে কারণে, এলাকাবাসী একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা প্রকল্পটি অনুমোদন ও অর্থ ছাড়সহ দ্রুত টেকসই বাঁধ নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানান। স্থানীয়দের অভিমত, বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে মেঘনার ভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু না হলে এবং ভাঙন এভাবে অব্যাহত থাকলে আগামী দু’বছরের মধ্যে কমলনগর উপজেলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মেঘনার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার লুধুয়া ফলকন এলাকার মাস্টার আবদুল মান্নান জানান, গত কয়েক বছর ধরে ভাঙনের মুখে পড়ে তাদের কয়েক একর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন বসতবাড়িটিও ভাঙনের হুমকির মুখে। ভাঙন প্রতিরোধের প্রকল্পটি অনুমোদন ও কাজ শুরু হলে বসত বাড়িটি ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেতো।তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমরা অন্য কিছু চাইনা, শুধু নদী ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে চাই। পাটারীরহাট ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ছালেম মৃধা জানান, শুষ্ক মৌসুমেও তাদের এলাকায় মেঘনার তীব্র ভাঙন চলছে। গত কয়েক সপ্তাহের ভাঙনে তার বসত বাড়ির বেশির ভাগ অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। জেলা পরিষদের সদস্য মোশারেফ হোসেন বাঘা জানান, গত সেপ্টেম্বর মাসে লুধুয়া ফলকন এলাকার চরফলকন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দু’টি দ্বিতল ভবন, একটি মসজিদ ও একটি কমিউনিটি ক্লিনিক ভবন রক্ষায় তারা ব্যক্তিগত অর্থায়নে প্রথমে জংলা বাঁধ দেন। পরবর্তীতে স্থানীয় সাংসদের প্রচেষ্টায় সেখানে জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু ভাঙনের তীব্রতার কারণে সেই ভবনগুলোও রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। সাহেবেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল খায়ের জানান, মেঘনার ভাঙনে তার ইউনিয়নের চারটি গ্রামসহ ৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে বসতভিটাসহ সর্বস্ব হারিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। ভাঙন অব্যাহত থাকায় এলাকাবাসী আতঙ্কে রয়েছেন। পাটারীরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট একেএম নুরুল আমিন রাজু জানান, ২০১৪ সালে ভাঙন প্রতিরোধের প্রকল্পটি অনুমোদনের পর তার ইউনিয়নের বাসিন্দারা বাপ-দাদার ভিটে-মাটিতে নতুন ভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু সাহেবেরহাট এলাকায় মাত্র এক কিলোমিটার বাঁধ হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থছাড় না হওয়ায় তারা এখন হতাশ হয়ে পড়েছেন। তিনি জানান, গেল বর্ষা মৌসুমে মেঘনার ভাঙনে তার ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ জনপদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এতে করে বসতবাড়ি ও ফসলি জমি হারিয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়েছেন। আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে ভাঙনরোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে তার ইউনিয়নের অনেক এলাকা নদীগর্ভে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফারুক আহমেদ জানান, মেঘনার ভাঙনরোধে কমলনগর ও রামগতি উপজেলার তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের নতুন ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়েছে। বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে থাকা নতুন প্রস্তাবনাটি অনুমোদন হলে ভাঙনরোধে টেকসই বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আবদুল মান্নান জানান, দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে মেঘনার ভাঙনে কমলনগর উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছেন। ভাঙন প্রতিরোধে ব্যক্তিগত অর্থে বাঁধ নির্মাণসহ তিনি বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ভাঙনের তীব্রতার কারণে তার উদ্যোগ সফল হয়নি।তিনি আরও জানান, ভাঙনরোধে নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ অনুমোদনের চেষ্টা চলছে। আশা করছি প্রকল্পটি অল্প সময়ের মধ্যেই একনেকে অনুমোদন হবে। আর এতে এ উপজেলাবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১