আপডেট : ২৯ December ২০১৯
জাতীয় নাগরিক তালিকা (এনআরসি) নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন ও সহিংসতা চলছে। এই অবস্থায় স্থলবন্দরগুলো দিয়ে মানুষের আসা-যাওয়া কমে গেছে। হিলি ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে পাসপোর্টধারী যাত্রী পারাপার প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। বেনাপোল, আখাউড়া ও ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে এখন পর্যন্ত যাত্রী পারাপার স্বাভাবিক রয়েছে। তবে ভারত থেকে ফিরে আসা যাত্রীরা জানিয়েছেন আন্দোলন-বিক্ষোভের কারণে ভোগান্তিতে পড়ার অভিজ্ঞতার কথা। হিলি ইমিগ্রেশন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ সীমান্ত দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ জন পাসপোর্ট যাত্রী দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত করেন। বছরের এই সময়টায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বন্ধসহ ছুটিছাটা বেশি থাকায় যাত্রীর চাপ বাড়ে। বর্তমানে সেই সংখ্যা কিছুটা কমে এসেছে। এখন দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ জনের মতো পাসপোর্টযাত্রী পারাপার হচ্ছেন। তাদের হিসাবে, গত ১ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিলি ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যান তিন হাজার ৩৮৩ জন যাত্রী। আর এ সময়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসেন ৮০৮ জন। আর চলতি মাসের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ভারতে যান এক হাজার ৮৩২ জন, এ সময়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসেন ৪৭ জন। যাত্রী পারাপার কমায় সরকারের রাজস্ব আয়ও কমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পাসপোর্টধারী যাত্রীদের চলাচল কমেছে। এদিকে ভারতে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন চিকিৎসা, ব্যবসা, ভ্রমণসহ বিভিন্ন কাজে ভারতে যাওয়া যাত্রীরা। ভারত থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরা খোকন নামের এক যাত্রী বলেন, ‘ভারতের চেন্নাইতে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম। ভারতে পাস হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার কারণে অনেক রুটে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে দেশে ফিরতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে।’ ভারতে যাওয়ার উদ্দেশে রেলের টিকিট কাটা আমান ও ফারুক নামের দুই যাত্রী বলেন, ‘গত ১৮ তারিখে ব্যবসা ও চিকিৎসার জন্য ভারতের কলকাতা ও চেন্নাইতে যাওয়ার জন্য ট্রেনের টিকিট বুক করা ছিল। ১৮ তারিখে ভারতে ঢুকব, সেই সময় জানতে পারি সেদিনের সেই ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। যার কারণে আমরা আর ভারতে যেতে পারিনি। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে আন্দোলন চলার কারণে ট্রেন ও বাস চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। যার কারণে অনেককে বাধ্য হয়ে বিমানে ভারতের বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসাসহ ব্যবসার কাজে যেতে হচ্ছে।’ হিলি কাস্টমসের এসআই বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘আগে হিলি ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে গড়ে প্রতিদিন বাংলাদেশ-ভারতের মাঝে যাওয়া-আসা মিলে সাতশ-আটশ জন পাসপোর্ট যাত্রী পারাপার করতেন। এখন গড়ে প্রতিদিন তিনশ-চারশ জনের মতো দুদেশের মধ্যে যাতায়াত করছেন।’ হিলি ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট পুলিশের এএসআই মোত্তালেব হোসেন বলেন, ‘ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে আগের চেয়ে যাত্রী পারাপার কিছুটা কমেছে। তবে কী কারণে কমেছে এটি বলতে পারছি না। তবে ভারতে এনআরসির কারণে কমেছে কি না-এমন কোনো কথা কোনো পাসপোর্ট যাত্রী আমাদের জানায়নি।’ বেনাপোলে যাত্রী পারাপার স্বাভাবিক : এনআরসির বড় কোনো প্রভাব পড়েনি যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরে। এই রুটে যাত্রীদের যাতায়াত স্বাভাবিক রয়েছে। ডিসেম্বরে ভারতে যাওয়া পাসপোর্টযাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে। ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় বেনাপোল চেকপোস্টে ভারতগামী পাসপোর্টযাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। বেনাপোল ইমিগ্রেশনে দীর্ঘ লাইন দেখা যায় যাত্রীদের। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারত গেছেন ৪৫ হাজার ২৯৪ জন পাসপোর্টধারী যাত্রী। আর ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন ৪১ হাজার ১৫৯ জন। মোট ৮৭ হাজার ৪৫৩ জন পাসপোর্টধারী ভারত-বাংলাদেশ যাতায়াত করেছেন। বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মহসিন খান পাঠান বলেন, ‘ভারতে এনআরসির কারণে পাসপোর্টধারী যাত্রী চলাচলে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। যাত্রী চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।’ যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সেলিম রেজা বলেন, ‘ভারতে এনআরসির কোনো প্রভাব সীমান্তে নেই। প্রভাব থাকলে অনুপ্রবেশ বাড়ত। বর্তমানে সীমান্তে কোনো অনুপ্রবেশ নেই।’ বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি মামুন খান জানান, ‘যশোরের সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতের এনআরসির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ পোর্ট দিয়ে পাসপোর্টধারী যাত্রী চলাচলও স্বাভাবিক রয়েছে।’ এনআরসির প্রভাব পড়েনি আখাউড়া স্থলবন্দরে : এনআরসি নিয়ে আসাম ও ত্রিপুরায় উত্তেজনা চললেও এর প্রভাব পড়েনি আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে যাত্রী পারাপারে। স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশনের পুলিশের ইনচার্জ আবদুল হামিদ বলেন, ‘গত তিন মাসের তুলনায় আখাউড়া স্থলবন্দর হয়ে ভারতে মানুষের যাতায়াত বেড়েছে। এ ছাড়া ডিসেম্বর মাস হওয়ায় স্কুল বন্ধ রয়েছে। যার কারণে অনেকে বেড়াতে ভারত যাচ্ছেন। ফলে দৈনিক গড়ে প্রায় এক হাজার যাত্রী পারাপার হচ্ছেন। এনআরসি নিয়ে আখাউড়া স্থলবন্দরে যাত্রী পারাপারে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। প্রতিদিনই চিকিৎসার জন্য আগরতলা বিমানবন্দর ব্যবহার করে দিল্লি, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালুরু, মুম্বাইসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যাতায়াত করছেন যাত্রীরা। তাদের কাছ থেকে কোনো নেতিবাচক কথা শুনিনি।’ ত্রিপুরা রাজ্য থেকে ফিরে আসা বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী যাত্রী বিশ্বজিৎ পাল বলেন, ‘তিন দিন আগে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার নেতাজি চৌমুহনী এলাকায় আমার এক আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে স্বজনদের সঙ্গে আগরতলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছি। কোথাও এনআরসি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিনি।’ ত্রিপুরা রাজ্য থেকে ফিরে আসা আখাউড়া রাধানগর গ্রামের বাসিন্দা সমীর চক্রবর্তী বলেন, ‘ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুর, পর্যটন এলাকা নীর মহলসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছি। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তবে কী হচ্ছে বা কী হবে এ নিয়ে কারো কারো মাঝে উদ্বেগ আছে।’ ভারতের ব্যাঙ্গালুরু থেকে ফিরে আসা হবিগঞ্জের রণক বর্মণ বলেন, ‘আমরা চিকিৎসার জন্য ভারতের ব্যাঙ্গালুরু গিয়েছিলাম আগরতলা বিমানবন্দর ব্যবহার করে। যেতে সমস্যা হয়নি। তবে ফেরার পথে সেখানকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভের কারণে সড়ক পথে যানবাহন বন্ধ ছিল।’ ভোমরা দিয়ে যাত্রী পারাপার স্বাভাবিক হলেও আতঙ্ক আছে : এনআরসি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভের ঘটনা ঘটলেও সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে যাত্রী পারাপারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। ভোমরা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম বলেন, ‘ভারতে অনেক স্থানে ট্রেন বন্ধসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পর্যটকসহ বিভিন্ন ধরনের যাত্রী কিছুটা কমেছে। কিন্তু আমাদের মালামাল আনা-নেওয়ায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’ সাতক্ষীরা শহরের কাটিয়া এলাকার আসিফ রহমান খান নামে এক বাংলাদেশি পর্যটক বলনে, ‘গত সপ্তাহে পাঁচ বন্ধু ভারতে নবাব সিরাজ উদ দৌলার স্মৃতিবিজড়িত এলাকা মুর্শিদাবাদ যাওয়ার ট্রেনের টিকিট কেটেছিলাম। এনআরসির কারণে হাওড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভকারীরা গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় ও ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করে। সে জন্য ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। আমরা মুর্শিদাবাদ যেতে পারিনি।’ ভোমরা স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী আবদুল কাদের বলেন, ‘আগে ব্যবসার কাজে মাসে দুই-চারবার ভারতে যেতাম। এনআরসি নিয়ে সমস্যার পর যেতে একটু ভয় লাগছে।’ ভোমরা ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ সরদার বলেন, ‘এনআরসির কারণে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে যাত্রী পারাপার স্বাভাবিক আছে। ভোমরা শুল্ক স্টেশন কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট শাখার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ইমাদুল হক বলেন, ‘ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে অধিকাংশ স্থানীয় লোকজন যাতায়াত করেন। তারা কেনাকাটা, ডাক্তার দেখানো এবং আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যান। এনআরসির প্রভাবে কলকাতার বাইরের যাত্রীর সংখ্যা কিছুটা কমেছে।’
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১