আপডেট : ২৬ December ২০১৯
সব ধর্মের মানুষকে শিক্ষিত জাতি হিসেবে গড়ার জন্য মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত বরিশালে বিএম স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। উপমহাদেশের শিক্ষার দূত, শ্রমিক কৃষক ছাত্র জনতার প্রিয় নেতা নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তিদাতা শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক এবং ভারতেশ্বরী হোমস স্কুল কলেজ ও হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা মানবকল্যাণে কাজ করেছেন। এই তিন মহান কৃতীমান ব্যক্তির আদর্শ অনুসরণ করে কাজ করেছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ফজলে হাসান আবেদ জন্মগ্রহণ করেছেন ইংরেজ শাসন-শোষণের আমলে ২৭ এপ্রিল ১৯৩৬ সালে বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে। পিতা সিদ্দিক হাসান ভূস্বামী ছিলেন এবং মাতা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। তার পূর্বপুরুষরা জমিদার ছিলেন। স্যার ফজলে হাসান আবেদ শিক্ষাজীবন শুরু করেন হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। তিনি তৃতীয় ও ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন এই বিদ্যালয়ে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হওয়ার আগেই তার পিতা অসুস্থ হয়ে যান এবং গ্রামের বাড়িতে এসে জীবনযাপন শুরু করেন। পিতার অসুস্থতার কারণে তখন ফজলে হাসান আবেদ তার চাচার কাছে চলে আসেন এবং কুমিল্লা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেন। তার চাচা জেলা জজ ছিলেন। চাচার জজের চাকরির কারণে কুমিল্লা থেকে পাবনায় বদলি হন। জনাব আবেদ চাচার সঙ্গে যান এবং পাবনা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। পাবনা জিলা স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর তিনি ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নৌ স্থাপত্যে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু সেটা বাদ দিয়ে লন্ডনের চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টসে ভর্তি হন। চার্টার্ড পাস করার পর সেখান থেকে ফজলে হাসান আবেদ ১৯৬২ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং শেল কোম্পানিতে চাকরি নেন। তার নিষ্ঠা ও একাগ্রতা দেখে কোম্পানির কর্মকর্তারা তাকে দ্রুত পদোন্নতি দেন এবং ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পান। তিনি তার মেধা দিয়ে সামনে চলতে থাকেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তা চলছিল বিরামহীনভাবে। ১৯৭০ শেলে চাকরিরত অবস্থায় তার সহপাঠী ও বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে হেল্প নামের একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলেন। ’৭০-এর ১২ নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড়ে বৃহত্তর বরিশাল ও নোয়াখালী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ১০ লাখ লোক মারা যায়। ওই অঞ্চলে ধন-সম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা আজো পূরণ হয়নি। সে সময় তিনি ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সেবা ও পুনর্বাসন করেন। সেবা ও পুনর্বাসনের অঞ্চল ছিল ভোলা জেলার মনপুরা। ’৭০-এর নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুর কাছে পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো পরস্পরের যোগসাজশে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের কারণে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ফজলে হাসান আবেদ যু্ক্তরাজ্যে চলে যান। সেখানে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের সব দেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য অর্থ তহবিল সংগ্রহ করেন। ফজলে হাসান আবেদ বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে অ্যাকশন বাংলাদেশ ও হেল্প বাংলাদেশ নামে দুটি সংগঠনের জন্ম দেন লন্ডনে। এই সংগঠন দুটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো- ভারতে যারা শরণার্থী হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা। নয় মাসের যুদ্ধের মাধ্যমে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। স্বাধীনতার পরপরই ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালিরা দেশে ফিরে আসেন। এদের সেবা ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সুনামগঞ্জের শাল্লা এলাকায় ফজলে হাসান আবেদ বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি সংক্ষেপে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। মৃত্যুর আগপর্যন্ত স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও ব্র্যাক একাকার হয়ে যায়। ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হলো দারিদ্র্য বিমোচন ও দরিদ্র নারীদের ক্ষমতায়ন। ব্র্যাক বর্তমানে বিশ্বের সেরা এবং সবচেয়ে বড় একটি বেসরকারি সেবা সংস্থা বা এনজিও। এশিয়া ও আফ্রিকার ১১টি দেশে ব্র্যাক এখন কাজ করছে। জেনেভাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এনজিও অ্যাডভাইজিং বিশ্বের শীর্ষে থাকা সেরা ৫০০টি এনজিও’র মূল্যায়ন করে বলেছে- প্রভাব, সৃজনশীলতা ও টেকসই হওয়ার বিচারে বিশ্বের সেরা এনজিও ব্র্যাক। দারিদ্র্য বিমোচন কাজের বাইরে ব্র্যাক জরুরি ত্রাণ সহায়তা, লিঙ্গসমতা, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নগর উন্নয়ন, মানবাধিকার ইত্যাদি কাজে অবদান রেখে চলেছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের সহায়ক যেসব প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন মানবজাতির জন্য, সেগুলো হলো— ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ব্যাংক, মোবাইল ব্যাকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশসহ বেশকিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আছে আড়ং, ব্র্যাক ডেইরি, ব্র্যাক চিকেন, ব্র্যাক ফিশারিজ, ব্র্যাক নার্সারি, ব্র্যাক প্রিন্টিং, ব্র্যাক সিল্ক, ব্র্যাক লবণ, ব্র্যাক স্যানিটারি ন্যাপকিন অ্যান্ড ডেলিভারি কীট এবং ব্র্যাক সিডসহ অনেক প্রতিষ্ঠান। যার মাধ্যমে গরিব সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, বিশেষ করে অসহায় নারীদের কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়ন হয়েছে। দেশের বাইরে ও দেশে স্যার ফজলে হাসান আবেদকে তার সেবার জন্য অনেক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণ সম্মানিত হয়েছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ দেশে-বিদেশে যেসব সম্মাননা পেয়েছেন, তার মধ্যে ১৯৮০ সালে র্যামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড ফর কমিউনিট লিডারশিপ লাভ অন্যতম। এর মাধ্যমে তার বিশ্বখ্যাতি অর্জনের সূচনা হয়। এরপর ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো নোমা পুরস্কার, ১৯৯০ সালে অ্যালানশন ফেইনস্টাইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরস্কার, ১৯৯২ সালে ইউনিসেফ মরিস পেট অ্যাওয়ার্ড, ২০০১ সালে ওলফ পামে অ্যাওয়ার্ড, ২০০২ সালে দ্য শোয়াব ফাউন্ডেশন সোশ্যাল এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যাওয়ার্ড, ২০০৩ সালে গ্লেইটসম্যান ফাউন্ডেশন পুরস্কার, ২০০৪ সালে গেটস অ্যাওয়ার্ড ফর গ্লোবাল হেলথ পুরস্কার ও মানব উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য ইউএনডিপি মাহবুবুল হক অ্যাওয়ার্ড, ২০০৭ সালে ক্লিনটন গ্লোবাল সিটিজেনশিপ অ্যাওয়ার্ড ও হেনরি আর ক্রাভিস প্রাইস ইন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (বিকেএসএফ) আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন। ২০০৮ সালে স্যার ফজলে হাসান আবেদ ডেভিড রকফেলার ব্রিজিং লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড পান; ২০১০-এ দারিদ্র্য বিমোচনে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে স্যার ফজলে হাসান আবেদ যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মানজনক নাইটহুড উপাধিতে ভূষিত হন। এর মাধ্যমে তিনি স্যার উপাধি লাভ করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় কাতার ফাউন্ডেশন ওয়াইপ্রাইজ লাভ করেন ২০১১ সালে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষায় অসামান্য অবদান রাখার জন্য সবচেয়ে বড় যে পুরস্কারটি পেয়েছেন, সেটি হচ্ছে ‘ইদান’ পুরস্কার, যার অর্থমূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৩ কোটি টাকা। এই পুরস্কারটি শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বের বড় স্বীকৃতি। এটি দিয়েছে হংকংয়ের ইদান প্রাইজ ফাউন্ডেশন। ২০০৮ সালে মানবিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ব্র্যাককে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পুরস্কার কনরাড এন হিলটন হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়। ২০১৩ সালে হাঙ্গেরির সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ন ইউনিভার্সিটি থেকে ওপেন সোসাইটি প্রাইজ লাভ করেন, খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ সালে তাকে দেওয়া হয় ওয়ার্ল্ড ফুডপ্রাইজ ও ২০১৬ সালে বিশব্যাপী দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য স্যার ফজেল হাসান আবেদ টমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র মেডেল অব গ্লোবাল পাবলিক হেলথ পদক লাভ করেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অশোকা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ ফরচুন ম্যাগাজিন স্যার ফজলে হাসান আবেদকে বিশ্বের শীর্ষ প্রভাবশালী ৫০ ব্যক্তিত্বের অন্যতম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ বছর নেদারল্যান্ডসের রাজা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে নাইটহুড উপাধি দিয়েছেন। তার এসব গৌরবের ভাগীদার বাংলাদেশের জনগণ ও বাঙালি জাতি। এ ছাড়া বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ পেয়েছেন ২০০৭ সালে। এই কৃতীমান পুরুষ ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর ঢাকায় এ্যাপোলো হাসপাতালে মাথায় টিউমারজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে জাতি যে যশস্বী পুরুষকে হারিয়েছে, সেই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। আর যদি আমরা তার কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করতে পারি, বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে, তাহলেই বাংলাদেশের মানুষ তাদের নবদিগন্ত সৃষ্টি করতে পারবে। ফজলে হাসান আবেদ এটাই চেয়েছিলেন। তার আত্মার শান্তি কামনা করি। এম এ জলিল লেখক : সভাপতি বাংলাদেশ জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১