বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২৫ December ২০১৯

ইতিকথা, মফস্বল সংবাদদাতা


পেশাগতভাবে আমি সাংবাদিক নই। তারপরও সময়ের অনিবার্য দাবি হিসেবে এ বিষয়টি নিয়ে লিখতে বাধ্য হলাম। আমরা জানি, সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। সময়ের দর্পণ হিসেবে এই পেশায় কর্মরত সংবাদকর্মীরা আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া অজস্র ঘটনাপ্রবাহকে সবার জন্য সহজলভ্য করে দিনের আলোয় প্রকাশ করেন। গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের সর্ববৃহৎ অংশটি মফস্বলে কাজ করেন। মফস্বলে কাজ করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজের চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী সাংবাদিকদের সুখ-দুঃখ আমরা কেউই লক্ষ করি না; না পত্রিকার মালিক পক্ষ, না স্থানীয় প্রশাসন, না সর্বসাধারণ।

যে কোনো সংবাদমাধ্যমের জন্য সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সাংবাদিক বলা হয়। সংবাদ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত থেকে এটিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করাই হলো সাংবাদিকতা। যুগ যুগ ধরে সাংবাদিকতা পেশা একটি মহৎ পেশা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যে কোনো ন্যায্য আন্দোলন-সংগ্রামে সংবাদমাধ্যমের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন,   উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলনে আমাদের সংবাদমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি ন্যায়সঙ্গত দাবির পক্ষে সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় এবং সাহিত্য পাতায় শক্তিশালী গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদি প্রকাশের মাধ্যমে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। সময়ের পরিক্রমায় সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। এডমন্ড বার্ক বলেছেন, ‘পার্লামেন্টের তিনটি রাষ্ট্র রয়েছে। কিন্তু ঐ যে দূরে সাংবাদিকদের আসন, সেটি হচ্ছে পার্লামেন্টের চতুর্থ রাষ্ট্র এবং আগের তিনটি রাষ্ট্রের চেয়ে তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ মি. বার্কের মতে সাংবাদিকতা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। শুধু তাই নয়, এডমন্ড বার্কের এই মতটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদপত্রের মূল চালিকাশক্তি মফস্বলের সাংবাদিক সমাজ। এরা শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমে অতি দ্রুততার সঙ্গে প্রেরণ করেন। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের চলমান সংবাদপ্রবাহ মানুষ খুব সহজে জানতে পারে। কঠিন কাজটি যারা সহজভাবে মানুষের নিকট উপস্থাপন করেন তাদের জীবনযাত্রার মান কেমন তা নিয়ে ভাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে।

মফস্বল সাংবাদিকতায় হাজারো সীমাবদ্ধতার মধ্যে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো— কাজটি ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। নিজস্ব এলাকায় কাজ করার সুবাদে পরস্পর সুপরিচিত হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে সংবাদ প্রকাশ করা জীবনের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল, সন্ত্রাসী গ্যাং এবং প্রশাসনিক ক্ষমতাবানের হাতে নিয়মিত মফস্বল সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। অনেক সংবাদকর্মী জীবন বিপন্ন হওয়ার শঙ্কায় ঘরবাড়ি, পরিবার-পরিজন ছেড়ে পালিয়ে বেড়ান। সংবাদ প্রকাশের কারণে সারা দেশে মফস্বলের অসংখ্য সাংবাদিকের জীবন চলে গেছে। মফস্বলের সংবাদকর্মীদের ওপর হামলা-মামলার ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক খবরে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি একটি উপজেলায় উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ করায় উপজেলা পর্যায়ের একজন সাংবাদিক নেতা, যিনি স্থানীয় প্রেস ক্লাবের নির্বাচিত সভাপতি, তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় একের পর এক মামলা। অপর উপজেলায় স্থানীয় পুলিশ ইন্সপেক্টরের অনিয়মের সংবাদ প্রচার করায় খুনের আসামি হতে হয় মফস্বলের একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধিকে। স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি সংবাদ প্রকাশের জেরে ঝরে গেছে মফস্বলে কাজ করা অনেক সংবাদকর্মীর জীবন। অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। এমন অসংখ্য ঘটনার নজির এ দেশে ভূরি ভূরি। অকাল প্রয়াত এবং অপঘাতে পঙ্গুত্বের শিকার এসব গণমাধ্যমকর্মীর পরিবার কী দুঃখ-দুর্দশায় জীবন পার করছে তার সংবাদও কেউ রাখে না। সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যম, সরকারের প্রতিনিধি বা সহকর্মীদের সংগঠনগুলাও বেমালুম ভুলে যায় তাদের কথা। সংবাদ প্রকাশের জেরে মফস্বল সাংবাদিকদের ওপর ধেয়ে আসা বিপদে অধিকাংশ সময়ই পাশে পাওয়া যায় না সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যম বা স্থানীয় প্রশাসনকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিপদগ্রস্ত সংবাদকর্মীর পাশে থাকে না বহুবিভক্ত সাংবাদিক সংগঠনসমূহ। বাংলাদেশের অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিহিংসার কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংবাদকর্মীদের এক পক্ষই অপর পক্ষকে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক বিপদে ফেলে দেয়। ফলে বিপদগ্রস্ত সংবাদকর্মীর ওপর অশুভ শক্তি অক্টোপাসের মতো ভয়ানকভাবে চেপে বসে।

কয়েকটি বড় দৈনিক পত্রিকা ব্যতীত অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমের মফস্বল প্রতিনিধিরা সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম থেকে কাজের বিনিময়ে কোনো মাসিক সম্মানী পান না। বরং তাদের ওপর বিজ্ঞাপন সংগ্রহের একটি বড় বোঝা চাপানো থাকে। বিজ্ঞাপনের বিল থেকে যৎসামান্য অংশ মফস্বলের সাংবাদিকরা পেয়ে থাকেন। এই সামান্য পয়সা উপার্জন কররার লক্ষ্যে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে গিয়েও তাদের শুনতে হয় নানান কটু কথা ও বিবিধ টিটকারী। এরপরও শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তারা রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা সংবাদ সংগ্রহের নেশায় নিমজ্জিত থাকেন। বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করা মফস্বলের সংবাদকর্মীদের যাপিত জীবন কেমন কাটে তা কী আমরা কখনো ভেবে দেখেছি! সারা দিন সংবাদ সংগ্রহের কাজে লিপ্ত থেকে গভীর রাতে বাসগৃহে ফিরে স্ত্রী-সন্তানদের সামনে কেমন বিব্রতকর অবস্থায় তারা হাজির হয়, তা কী আমরা কখনো ভেবেছি! তারাও তো মানুষ, রোবট নয়। তাদের মৌলিক চাহিদা অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতোই। তাহলে তারা কাজের বিনিময়ে সম্মানি পাবেন না কেন? আমাদের দেশে সহস্রাধিক জাতীয় দৈনিকের উৎপত্তি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে খুব সহজেই হয়ে যায়; আবার খুব সহজে কোনো কোনো গণমাধ্যম বন্ধও করে দেওয়া যায়। কিন্তু কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীদের ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়নই যেন একমাত্র কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়। সময়ের আবর্তনে যুগ পাল্টাচ্ছে, মানুষের চাহিদায় নতুনত্ব যোগ হচ্ছে, কিন্তু মফস্বলে কাজ করা সংবাদকর্মীদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবার ভেবে দেখা উচিত।

মফস্বলে কাজ করা সাংবাদিকদের প্রতি সর্বসাধারণের কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে। প্রথম অভিযোগ হলো, অধিকাংশ মফস্বল সাংবাদিকের শিক্ষাগত যোগ্যতা খুবই কম। অভিযোগের বিপরীতে দায়িত্ব নিয়ে বলা যায়, অসংখ্য উচ্চশিক্ষিত সংবাদকর্মী মফস্বলে কাজ করছেন। আবার অধিক শিক্ষাগত যোগ্যতার বিপুলসংখ্যক সংবাদকর্মী সংগ্রহ করা সম্ভব কি না সেটিও ভেবে দেখতে হবে। তা ছাড়া বিনা বেতনে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী সংবাদ মাধ্যমের মফস্বল প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন কি না সেটিও ভাবতে হবে। সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমগুলো কর্মী নিয়োগের সময় অন্যান্য পেশাজীবীকে অগ্রাধিকার প্রদানপূর্বক শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি প্রাধান্য দিতে পারে। কিন্তু অন্যান্য পেশাজীবীরা পার্ট টাইম সংবাদ সংগ্রহকারী হিসেবে সঠিকভাবে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারবেন কি না সেটিও বিবেচনা করা উচিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মফস্বলের সংবাদ সংগ্রহ করতে বড় বড় ডিগ্রির খুব বেশি প্রয়োজনও হয় না। মফস্বল প্রতিনিধির পাঠানো সংবাদ প্রয়োজনীয় সংশোধনের জন্য বার্তা কক্ষে অনেক অভিজ্ঞ সম্পাদনা সহকারী বসে থাকেন। সুতরাং মাঠপর্যায়ে কাজ করা সংবাদকর্মীদের খুব বেশি একাডেমিক শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। মফস্বলে কাজ করা সাংবাদিকদের প্রতি আরো একটি অভিযোগ হলো, তাদের মধ্যে অধিকাংশ সংবাদকর্মী সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বিভিন্ন জনের নিকট থেকে টাকা দাবি করেন। কাজটি সঙ্গত কারণেই অনৈতিক। কেউ টাকা দাবি করে বসলে সর্বসাধারণ টাকা না দিলেই হয়ে যায়। যারা অনৈতিকভাবে টাকা প্রদান করেন, আবার তারাই সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে অবৈধ পন্থায় অর্থ আদায়ের অভিযোগ করেন, ব্যাপারটি হাস্যকর।

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ সংবাদপত্রের ধারাবাহিক গতি প্রবহমান রাখতে মফস্বলে কাজ করা সংবাদকর্মীদের নির্বিঘ্নে কাজ করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার দায়িত্বও সংশ্লিষ্টদের গ্রহণ করতে হবে। সংবাদকর্মীদের বৃহত্তম অংশ মফস্বল সাংবাদিকদের বাদ দিয়ে কোনো সংবাদ মাধ্যমই পরিপূর্ণ গতিশীল হতে পারে না। রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় প্রশাসন ও গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিদের উচিত মফস্বলে কাজ করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী অদম্য সাহসী সংবাদকর্মীদের প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখা।

মুহাম্মদ ইয়াকুব

লেখক : প্রাবন্ধিক

 


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১