বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২২ November ২০১৯

বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন


পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এটি ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত। বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারি নথি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসেবে সুন্দরবনের মোট আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশের অংশে রয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার ও ভারতীয় অংশে ৩ হাজার ৯৮৩ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের মোট বনাঞ্চলের ৪৭ ভাগই হলো সুন্দরবন এবং বন বিভাগের রাজস্ব আয়ের অর্ধেকেরও বেশি আসে সুন্দরবন থেকে। এ বন থেকে আমরা প্রচুর পরিমাণে কাঠ, জ্বালানি, মাছ, মধু ও মোম সংগ্রহ করে থাকি। প্রতি বছর সুন্দরবন থেকে প্রায় ৯৭ হাজার টন গোলপাতা, ২২০ টন  মধু এবং ৫০ টন মোম আহরণ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ বন আমাদের দেশকে প্রাকৃতিক দুর্গের মতো রক্ষা করে।

সুন্দরবন লোনা পরিবেশের সব থেকে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর মোহনায় এর অবস্থান। ১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এর ওপর প্রায় ১২ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। দেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের অবদান প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।

সুন্দরবন আমাদের জাতীয় সম্পদ। সুন্দরবনে রয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবনকে ইউনেস্কো ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা আমাদের এ সম্পদকে যথাযথভাবে ব্যবহার বা রক্ষা কোনোটিই করতে পারছি না। ফলস্বরূপ সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি ছোট হয়ে আসছে বনের আয়তন। বিগত ২০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমেছে প্রায় অর্ধেক। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে সুন্দরবন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিকাল ইনফরমেশন সার্ভিস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ সুন্দরবনের ভূমি ও উদ্ভিদের পরিবর্তনের ধরন নিয়ে দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। গবেষণা থেকে প্রাপ্য তথ্যানুযায়ী সুন্দরবনের ভূখণ্ড কমছে আর জলাভূমি বাড়ছে। মূলত সুন্দরবনের নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙনের ফলে সুন্দরবনের আয়তন কমছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।

অপরদিকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ব্যাপক হারে নৌযান চলাচলের কারণে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং জীববৈচিত্র্য। ইতোমধ্যে সুন্দরবনের গাছের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ব্যাপক হারে। ১৯৫৯ সালে যেখানে প্রতি হেক্টরে গাছ ছিল ২৯৬টি তা কমে ১৯৮০-তে ১৮০টি এবং ১৯৯৬ সালে ১৪৪টিতে এসে দাঁড়ায়। এভাবে চলতে থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ গাছের সংখ্যা দাঁড়াবে মাত্র ১০৯-এ। বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরীর সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছে দ্রুত হারে। বনের বৃক্ষের সংখ্যা হ্রাসের সাথে সাথে বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি হারাচ্ছে তাদের আবাসস্থল। ফলস্বরূপ হ্রাস পাচ্ছে পশুপাখির সংখ্যাও।

সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া জাতিসংঘের সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও ঐতিহ্যবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির এক নম্বর কারণ হিসেবে ফারাক্কা বাঁধকে চিহ্নিত করেছে। গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের কারণে সুন্দরবনের নদীতে মিষ্টি পানিপ্রবাহের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে এসেছে। কিন্তু বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য মিষ্টি পানিপ্রবাহের প্রয়োজন। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে খরার সময় বিপুল পরিমাণ পানি উজানে আটকে রাখা হয়। এ সময় সমুদ্র থেকে ব্যাপক হারে লোনা পানি বনের ভেতর প্রবেশ করে। এতে সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বনের নদীর বুকে পলি জমে যাওয়ার পরিমাণও বেড়ে গেছে। যা সুন্দরবনের প্রতিবেশব্যবস্থাকে নষ্ট করছে। ফলে সুন্দরবনের গাছ ও প্রাণীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে।

ইউনেস্কোর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, সুন্দরবনের মিষ্টি পানিপ্রবাহের পরিমাণ যত কমছে, লবণাক্ত পানির প্রবাহ ততই বাড়ছে এবং জীববৈচিত্র্যের পরিমাণ কমছে। এভাবে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকলে সুন্দরবনের অনেক বৃক্ষ ও প্রাণী আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এছাড়া অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, ব্যাপক হারে বৃক্ষ নিধন, অবৈধভাবে বনের পশুপাখি শিকার এবং বনের নদীতে বিভিন্ন সময়ে নৌযানডুবির ঘটনায় বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। সুন্দরবন আমাদের জাতীয় সম্পদ। দেশের অর্থনীতিতে অবদানের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সুন্দরবন প্রাকৃতিক দুর্গের মতো কাজ করে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রবল বায়ুপ্রবাহ প্রতিহত করতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে সুন্দরবন।

সুন্দরবন আমাদের জাতীয় বন, জাতীয় সম্পদ। আমাদের সচেতনতার অভাবে এ বন আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এ বন রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। প্রথমত, সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে যত অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে সেগুলো বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বনের বৃক্ষনিধনকারী ও পশুশিকারিদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। বনের নদীগুলো দিয়ে চলাচলকারী নৌযানগুলোর দিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সেখানে মিঠাপানি প্রবাহের পরিমাণ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এ সমস্যা মোকাবেলায় আমাদের কিছু সুচিন্তিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে যাতে গঙ্গা চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হয় এবং সুন্দরবনের মিষ্টি পানিপ্রবাহের পরিমাণ বাড়ানো যায়। শুধু মিষ্টি পানিপ্রবাহের পরিমাণ বাড়ালেই হবে না, নিয়মিতভাবে সুন্দরবনের পানির গুণগত মান, লবণাক্ততা এবং সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং কোনো সমস্যা হলে তা দ্রুত সমাধানের উদ্যোাগ নিতে হবে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুন্দরবনকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে সুন্দরবন বাঁচলে দেশ বাঁচবে।

আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা

লেখক : শিক্ষার্থী, কৃষি অনুষদ

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১