আপডেট : ২৮ September ২০১৯
কিছুটা পেছনেই তাকাই। ২০১৭ সালে পানামা পেপাসর্ এবং প্যারাডাইস পেপার্স অফশোর ব্যাংকিংয়ের নামে বিদেশে টাকা পাচারের যে তথ্য প্রকাশ করেছিল, সেখানে বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের নাম উঠে আসে। এমন এক পরিস্থিতিতে পিপল্স অ্যান্ড পলিটিক্স এক ব্যতিক্রমী প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে বিশ্বের ৫ জন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিহ্নিত করা হয়েছে যাদের কোনো দুর্নীতি স্পর্শ করেনি। এদের বিদেশে কোনো ব্যাংক হিসাব নেই, উল্লেখ করার মতো কোনো সম্পদও নেই। সেই তালিকায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী জায়গা করে নিয়েছেন তৃতীয় স্থানে। ১৭৩টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে এই গবেষণা সংস্থাটি মাত্র ১৭ জন সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান পেয়েছেন যারা ৫০ ভাগ দুর্নীতিমুক্ত হিসেবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই গৌরবময় অর্জন বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্থান করে দিয়েছে। তাঁর মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধও তাঁকে দিয়েছে উচ্চ আসন। অর্জন করেছেন ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ ও ‘লেডি অব ঢাকা’ খেতাব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই অর্জন বাংলাদেশকে নতুন মাত্রায় পরিচিতি দিয়েছে, তেমনই আরো কিছু বিষয় রয়েছে যেসব ক্ষেত্রে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাতি হিসেবে আমরা অগ্রগণ্য বলে বহির্বিশ্বে বিবেচিত হচ্ছি। জাতির গৌরব সাতই মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নাম, একটি ইতিহাস। তাঁর জীবন ছিল সংগ্রামমুখর। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন সংগ্রামী নেতা। বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ ৬ দফার প্রণেতাও ছিলেন তিনি। ’৭০-এর নির্বাচনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে এ দেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত করেন। ১৯৭১-এর সাতই মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উত্তাল সমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বজ্রদৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর সেই বক্তব্যকে তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাকসংবলিত জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের সাতই মার্চ দেওয়া ভাষণকে গত বছর স্বীকৃতি দিল ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশনাল, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন (ইউনেস্কো)। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। ৪৬ বছর আগে বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণায় উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত জাতি স্বাধীনতার মূলমন্ত্র পাঠ করে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ছিনিয়ে আনে দেশের স্বাধীনতা। জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি এই স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে তাই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত তাঁর সাতই মার্চের ভাষণ। ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড কর্মসূচির অধীনে আন্তর্জাতিক তালিকায় মোট ৭৮টি দলিলকে অনুমোদন দেওয়া হয়, যার ৪৮তম স্থানে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ঐতিহাসিক এই ভাষণ। ইতিহাসের পাতায় বঙ্গবন্ধু আজ চিরঞ্জীব, তেমনি তাঁর সাতই মার্চের ভাষণও চির জাগরূক হয়ে রইল। স্বপ্নের সেতু পদ্মা পদ্মা সেতু আজ বাংলাদেশের মানুষের ‘স্বপ্নের সেতু’। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন। এই সেতু বাস্তবায়িত হলে খুলনা, বরিশালসহ পুরো দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। মূল সেতুটি দোতলা হবে। পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত পদ্মা বহুমুখী সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন আর নিচে দিয়ে ট্রেন চলাচল করবে। এশিয়ান হাইওয়ের পথ হিসেবেও সেতুটি ব্যবহূত হবে। অথচ এই সেতু নির্মাণের শুরুটা ছিল জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জার। গত বছর পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলার রায়ে কানাডার আদালত একে নিছক গুজব ও অনুমাননির্ভর বলেছে এবং কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দিয়েছে। এর মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির যে অভিযোগ তুলেছিল বিশ্বব্যাংক তা থেকে মুক্তি পায় জাতি। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো একটি স্থাপনার উদ্যোগ নেওয়া সাহসী কাজ। সেই সাহসের বিজয় নিশান উড়িয়েছেন বর্তমান সরকার ও আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কথায় আছে- ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার।’ বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ আবারো প্রমাণ করল অন্যায়ের কাছে সে মাথা নোওয়াবার নয়। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত আজ সঠিক বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। পদ্মা বহুমুখী সেতু বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মর্যাদা পাবে। মেট্রোরেল প্রকল্প রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনাজনিত দুর্ভোগ রাজধানীবাসীর নিত্যসঙ্গী। এ অবস্থার উত্তরণে রাজধানীতে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ মেট্রোরেল প্রকল্প। গত বছর ঢাকা মেট্রোরেলের প্রথম পর্যায়ের উড়ালপথ ও নয়টি স্টেশন নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রথম পর্যায়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার এই রেলপথ নির্মাণ করা হবে। উত্তরা, মিরপুর, রোকেয়া সরণি, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও হোটেল, শাহবাগ, দোয়েল চত্বর ও তোপখানা রোড হয়ে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেল নেটওয়ার্কে মোট ১৬টি স্টেশন থাকবে। এই মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকায় মোট ১৪টি ট্রেন উভয় দিকে প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী বহন করবে। প্রতি তিন মিনিট অন্তর অন্তর স্টেশনগুলোতে ট্রেন থামবে। মেট্রোরেলে চড়ে একজন যাত্রী উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার পথ ৩৫ মিনিটে যেতে পারবেন। প্রতিটি ট্রেনের ছয়টি করে বগি থাকবে। এর সবই হবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে এই মেট্রোরেলে। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ উদ্বোধন করা সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে রাজধানীতে পূর্ব-পশ্চিমমুখী সড়কের সংখ্যা কম। কাজেই মেট্রোরেলের পূর্ব-পশ্চিমমুখী রুটগুলো দ্রুত চালু হলে এক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, সন্দেহ নেই। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশ পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের দেশগুলোর ক্লাবে প্রবেশ করল ২০১৭-তে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনকে (বিএইসি) বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বিএইআরএ) কর্তৃক রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল নির্মাণকাজের জন্য ডিজাইন ও কনস্ট্রাকশন লাইসেন্স দেওয়ায় এই লক্ষ্য অর্জিত হয়। গত বছর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজ উদ্বোধন করেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ধার্য ৫ হাজার ৮৭ কোটি ৯ লাখ টাকার প্রথম পর্যায়ের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হয়েছিল। ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় বা শেষ পর্যায়ের কাজও গত বছর শুরু হয়। দুই পর্যায়ে মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ১৮০ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির কাজ ২০১৩ সালে শুরু হয় যা শেষ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। আশা করা যাচ্ছে দুই ইউনিটের এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। উপরন্তু এই প্রকল্প এলাকাকে ঘিরে গ্রিনসিটি আবাসন পল্লী নির্মাণের কাজও এগিয়ে চলেছে। এখানে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত ব্যক্তিদের আবাসন, মাল্টিপারপাসহল, মসজিদ ও স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্বনমুক্ত ও বেজলোড বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে দেশের প্রথম পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রূপপুর। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গত বছরের উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মধ্যে রয়েছে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণ। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে এটি উৎক্ষেপণ করা হয়। সফলভাবে এই উপগ্রহ উৎক্ষেপণ হওয়ায় বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হলো বাংলাদেশ। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অবস্থান হচ্ছে ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। এই কক্ষপথ থেকে বাংলাদেশ ছাড়াও সার্কভুক্ত সব দেশসহ ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমিনিস্তান ও কাজাখস্তানের কিছু অংশ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের আওতায় এসেছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এই স্যাটেলাইট দিয়ে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও টেলিচিকিৎসা, ই-শিক্ষা, গবেষণা, ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) সেবা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় জরুরি যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হচ্ছে এই স্যাটেলাইট। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ জাতি হিসেবে বাঙালিকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ৭৩তম জন্মদিনে তাই বলতে হয় যে, কতটা ধৈর্য, কর্মনিষ্ঠতা এবং আত্মপ্রত্যয় থাকলে একটি জাতিকে বিশ্বের দরবারে অনন্য রূপে তুলে ধরা যায়। বলা যায় তিনি নতুনভাবে যাত্রা শুরু করেছিলেন ২০০৯ সাল থেকে। বিশ্বাস করি জাতি হিসেবে বাঙালি অপরাজেয়। অসীম সাহস, শক্তি, সহনশীলতা আর প্রজ্ঞা দিয়ে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সফল হব।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১